মা জননী, ছেলের কথায় রাগ করোনি তো?
দু’এক মিনিট দূর্বা কোনকথা বলতে পারে না। মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ ওনার দিকে তাকিয়েই চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে, কোন মা কি ছেলের কথায় রাগ করতে পারে?
ওর চোখের জল দেখে সবার চোখই ভিজে ওঠে কিন্তু কারুর মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরোয় না। সবাই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে যান।
দুর্বা আবার ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি আপনাকে কি বলে ডাকব?
সুব্রতবাবু দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলেন, মা জননী, তুমি শুধু তোমার বাবাকেই বাবা বলবে আমাকে তুমি ছেলে বলে ডাকবে।
ছেলে!
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বা ওনার বুকের উপর মুখোনা রেখেই আনন্দে খুশিতে গর্বে চোখের জল ফেলে।
দুর্বার ছেলেও মা জননীর চোখের জল দেখে নিজেকে সংযত রাখতে পারেন।
সারদা পাশেই দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তবুও শিবানী চিৎকার করে ওঠেন, শিল্পী আর ওর ছেলে ছাড়াও আমাদের সবাইকে কফি দাও।
সারদা একটু পরেই সবাইকে কফি দিয়েই বলে, বাবাই সোনা কোথায় গেল?
শিবানী বলেন, ও যেখানেই থাক, ওকে ধরে আনো এখানে।
হ্যাঁ, সারদা তাতাইয়ের ঘর থেকে ওকে টেনে আনে।
শিবানী বলেন, আয় বাবা, আমার কাছে আয়।
সবার মনেই কত কথা, কত গুঞ্জন কিন্তু কারুর মুখ দিয়েই কোন কথা বেরোয় না।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়েই দুর্বা সুব্রতবাবুর এক হাত দু’হাতের মধ্যে নিয়েই বলে, ছেলে, তুমি গান শুনতে চেয়েছিলে, তাই শুরু করছি–
কেন তোমরা আমায় ডাকো
পাই নে সময় গানে গানে।
পথ আমারে শুধায় লোকে
পথ কি আমার পড়ে চোখে,
চলি যে কোন দিকের পানে
গানে গানে।
দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি,
নিই নে কানে।
মন ভেসে যায় গানে গানে।
আজ যে কুসুম-ফোঁটার বেলা,
আকাশে আজ রঙের মেলা,
সকল দিকেই আমায় টানে
গানে গানে।
কেন তোমরা আমায় ডাকো,
আমার মন না মানে।
গান শেষ হতেই ভারতী দুর্বাকে কাছে টেনে নিয়ে এক গালে চুমু খেয়ে বলেন, সত্যি, তোমার গান শুনে মন যে কোথায় চলে যায়…
শিবানী বলেন, শিল্পী, তোমার কাছে এইসব গান শুনে আর মনে হয় না, আমরা এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর বাসিন্দা।
হঠাৎ সারদা বেশ গলা চড়িয়ে বলে, ও বড়মা, দারুণ মেঘ করেছে। মনে হচ্ছে এখুনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
ভারতী যেন বকুনি দিয়ে বলেন, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে, তা অত বলার কি আছে? সুনন্দারা তো গাড়ি নিয়েই এসেছে। অত চিন্তার কি আছে?
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, আর যদি তেমন বৃষ্টি হয় যে গাড়িও চালানো যাবে না, তাহলে ওরা আজ এখানেই থাকবে। ওরা তো জলে পড়েনি।
সুব্রতবাবু বলেন, ঠিক বলেছ বৌমা।
ওনার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া।
এক মুহূর্ত দেরি না করে দুর্বা গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।
চেনাশোনার কোন বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে
যেখানে অকারণে যায় ছুটে।
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।…
দুর্বা গান থামিয়েই হেসে ওঠে।
মা জননী, থামলে কেন? গানটা শেষ করো।
ছেলে পুরো গানটা শোনাতে হবে?
নিশ্চয়ই।
দুর্বা হাসতে হাসতেই আবার শুরু করে।
ঘরের মুখে আর কি রে
কোনো দিন সে যাবে ফিরে।
যাবে না, যাবে না–
দেয়াল যত সব গেল টুটে।
বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যবেলা
কোন্ বলরামের আমি চেলা,
আমার স্বপ্ন ঘিরে
নাচে মাতাল জুটে।
যত মাতাল জুটে।
যা না চাইবার
তাই আজি চাই গো,
যা নাপাইবার
তাই কোথা পাই গো।
পাব না, পাব না,
মরি অসম্ভবের পায়ে
মাথা কুটে।
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে।
গান শেষ হতেই দুর্বা দুহাত দিয়ে সুব্রতবাবুর মুখোনা ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে, ছেলে, আজ আসি। মা-র কাছে আসতে ভুলে যেও না।
তারপর ওনাকে প্রণাম করেই দুর্বা প্রণাম করে ভারতী-শিবানীকে।
সঙ্গে সঙ্গে ভারতী বলেন, দেখছিস শিবানী, তোর শিল্পী কি এক চোখা? ওনাকে আদর করলো আর আমরা কি গঙ্গার জলে ভেসে এসেছি?
তোমাদের দুটো করে ছেলে আর আমার একটা ছেলে। আমি তো ওকে বেশি আদর করবই।
দুর্বা হাসতে হাসতেই বলে, সারদা মাসী, গুড নাইট। এর পর যেদিন আসব,
সেদিনও আজকের মতো ইলিশ মাছ খাওয়াবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাওয়াবো।
সুনন্দাও সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। ওরা দুজনেই যাবার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ দুর্বা পিছন ফিরে কোনমতে হাসি চেপে সবাইয়ের দিকে চেয়ে বলে, এই যে দুই মায়ের আদরের বাবাই সোনা, গুড নাইট! সী ইউ এগেন।
দুর্বা প্রায় লাফ দিয়ে গাড়িতে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে। দু’এক মিনিটের মধ্যেই দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
সুব্রতবাবু বললেন, সী কেম, সী স’, সী কংকার্ড!
হ্যাঁ, দাদা, ও ঠিক কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতো আমাদের সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
০৪. সেদিন কমনরুমে বসে
সেদিন কমনরুমে বসে নানা কথাবার্তার মধ্যেই হঠাৎ নমিতা ঘোষাল একটু কৌতুক মেশানো হাসি হেসে বলেন, আচ্ছা ভারতী, তোর বরের নাম সুব্রত, তাই না?
হ্যাঁ।
ছেলের নাম দেবব্রত?
হ্যাঁ।
তোর দেওরের নাম কি ছিল?
তপোব্রত।
ওর ছেলের নাম?
শুভব্রত।
নমিতা একটু হেসে বলেন, বাঃ! বেশ মিলতো সবার নামে! সবার নামের শেষেই ব্রত!