ভারতী রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, শিবানী তোর দাদাকে আসতে বল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। সুব্রতবাবুকে নিয়ে ড্রইংরুমে পা দিয়েই শিবানী বলেন, সুনন্দা, আমার দাদা।
সুনন্দা প্রণাম করতেই উনি বলেন, থাক, থাক, হয়েছে বৌমার কাছে আপনার আর আপনার মেয়ের কথা প্রায় রোজই শুনি।
দুর্বা একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। শিবামী ওকে টেনে এনে সুব্রতবাবুর সামনে এনে বলে, দাদা, এই আমার শিল্পী।
দুর্বা ওকে প্রণাম করতেই সুব্রতবাবু ওর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে একটু হেসে বলেন, মা, বৌমার কাছে শুনেছি তুমি অসাধারণ গান গাও।
মাসীমা স্নেহ করেন বলে অনেক বেশি বাড়িয়ে বলেছেন। আমি একটু-আধটু গান গাই ঠিকই কিন্তু অসাধারণ কখনই না।
দেখো মা, আমার বৌমা তো সে ধরনের মেয়ে না। উনি কখনই অহেতুক কিছু বাড়িয়েও বলবেন না, ছোট করেও কিছু দেখাবেন না। বৌমা অসম্ভব ব্যালান্সড় মেয়ে।
ওনার কথা শুনে সুনন্দাও হাসেন, দুর্বাও হাসে।
সুব্রতবাবু একটু হেসে বলেন, মা, আজ যখন সৌভাগ্যক্রমে তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলো, তখন একটা গান না শুনিয়ে যেও না।
দুর্বা একটু মুখ নীচু করে বলে,, নিশ্চয়ই গান শুনিয়ে যাবো।
সবাই মিলে এক সঙ্গে খেতে বসেও কত কথা, কত গল্প আর হাসাহাসি হয়। অন্যরা বুঝতেও পারে না। কিন্তু এইসব গল্পগুজব আর হাসাহাসির মধ্যেই বাবাই মাঝে মাঝেই কয়েক মুহূর্তের জন্য দুর্বার শ্রীমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনও কখনও দুর্বাও ওকে না দেখে পারে না। আবার এরই মধ্যে কয়েকটা দুর্লভ মুহূর্তের জন্য ওদের দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই লজ্জায় ওরা। দৃষ্টি গুটিয়ে নেয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর সবার মনেই খুশির জোয়ার। আবার সবাই জমায়েত হন ড্রইংরুমে। সেখানেও আড্ডা জমে যায়।
হঠাৎ সারদা এসে ভারতাঁকে বলে, ও বড়মা, আপনারা তো কেউ কিছু বলছেন না।
ও একটু হেসে বলে, অন্য রবিবার তা চারটে বাজতে না বাজতে চায়ের জন্য আপনারা অস্থির হয়ে ওঠেন। আর আজ পাঁচটা বাজতে চললো কিন্তু তবু…
দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, সত্যিই তো পাঁচটা বাজতে মাত্র মিনিট দশেক বাকি। যাও, যাও, চটপট কফি করো।
দুর্বা একটু হেসে বলে, দোষ হয় আমাদের মত ছেলে মেয়েদের। আমরা নাকি আড্ডা দিতে বসলে কোনদিকে কোন হুঁস থাকে না কিন্তু আজ দেখলাম, আড্ডায় মেতে গেলে আমাদের গুরুজনদেরও কোনদিকে খেয়াল থাকে না।
ভারতী গম্ভীর হয়ে বলেন, ওরে আদরিণী, আমরা আড্ডা দিই হাজার রকম দায় দায়িত্ব কাজকর্ম মিটিয়ে কিন্তু তোমরা?
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে এক হাত দিয়ে ওনার গলা জড়িয়ে গেয়ে ওঠে।
মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ
আনিস নে কি ভাই।
তাই কাজকে কভু আমরা না ডরাই।।
খেলা মোদের বাঁচা মরা,
খেলা ছাড়া কিছুই কোথাও নাই।।
খেলতে খেলতে ফুটেছে ফুল।
খেলতে খেলতে ফল যে ফলে।।
খেলারই ঢেউ জলে স্থলে।
ভয়ের ভীষণ রক্ত রাগে
খেলার আগুণ যখন লাগে।
ভাঙাচোরা জ্বলে যে হয় ছাই।।
মোদের যেমন খেলা
তেমনি যে কাজ
জানিস নে কি ভাই।
গান শেষ হতেই সবাই হৈ হৈ করে ওঠেন, শুধু বাবাই নীরব। ওর চোখে মুখে খুশি ফুটে উঠলেও মুখে কিছু বলতে পারে না। সুব্রতবাবু দুর্বার দুটি হাত ধরে বলেন, মা জননী, তোমার মতো মেয়েকে তো ছেড়ে থাকা মুস্কিল।
শিবানী এক মুহূর্তের জন্য ভারতীর দিকে তাকিয়েই বলেন, দাদা, ছেড়ে থাকা মুসকিল মানে? আপনি কি অবিবাহিতা দুর্বাকে আটকে রাখবেন?
হ্যাঁ, বৌমা, ওকে আটকে রাখবো তোমাদের বাবাইসোনার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে।
ওনার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বাবাই আর দুর্বা ছিটকে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে।
সুনন্দা সুব্রতবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেন, দাদা, আপনি যে আজ আমাকে কি নিশ্চিন্ত করলেন, তা বলতে পারবো না। শুধু কায়মনোবাক্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, ময়না যেন আপনাদের সবাইকে সুখী করতে পারে।
বৌমা, আপনার মেয়েকে…
দাদা, দয়া করে আপনি বলবেন না। আমি তো শিবানীদিরই বয়সী।
আচ্ছা, আচ্ছা, তুমিই বলব।
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, বৌমা, মেয়েকে দেখে আর কথাবার্তা বলে যদি সত্যি আনন্দ আর শান্তি না পেতাম, তাহলে কি আমি ওকে মা জননী বলতাম?
এবার উনি সুনন্দার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বৌমা, আমার মা জননী আমাদের কাছে সুখে শান্তিতেই থাকবে। কোন চিন্তা নেই।
ভারতী আর শিবানী আনন্দে খুশিতে দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরেন আর শুধু হাসেন।
হঠাৎ শিবানী ওনাকে ছেড়ে দিয়েই সুনন্দার হাত ধরে টান দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ওহে মহারানী, দেখলে, কেমন ঘটকালি করলাম?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি আবার বলেন, আমার প্রাপ্যটার কথা ভুলে যেও না।
সুব্রতবাবু বলেন, বৌমা, আমার মা জননীকেই তো তোমরা পাচ্ছো। আর কি প্রাপ্য চাও?
শিবানী চাপা হাসি হেসে বলেন, দাদা, আপনি আমাকে পথে বসিয়ে দিলেন। ভেবেছিলাম, শিল্পীর মা-বাবার ঘাড় ভেঙে অন্তত দশ ভরির একটা ভাল হার…
সবাই হাসেন।
সুব্রতবাবু গলা চড়িয়ে বলেন, মা জননী, কোথায় গেলে?
খুব ধীর স্থির পদক্ষেপ দুর্বা শিবানীর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওনার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ নীচু করে বলে, আপনি কিছু বলবেন?