একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি বাবা চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছেন। আমাকে দেখেই একবার আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম জলভরা ভারে মেঘের মতো দুটো চোখ টল টল করছে। আমি যেন সহ্য করতে পারলাম না। বেরিয়ে এলাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমাকে ডাকলেন, খুকি মা, শুনে যা।
আমি কাছে যেতেই বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথা রেখে অসহায় ছোট বাচ্চার মতো কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোর মা চলে গেলে আমরা কি করে বাঁচব রে খুকি? এই পৃথিবীতে আমার তো আর কোনো বন্ধু নেই।
ভাই রিপোর্টার, সে দুঃখের দিনের কথা এত বছর পরও লিখতে গিয়ে আমার দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছে। বাবার শৈশব-কৈশোর আমি দেখিনি। তার প্রথম যৌবনের খবরও আমি জানি না, কিন্তু আমার জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখেছি মা ছাড়া বাবা এই পৃথিবীর আর কিছু চিনতেন না, জানতেন না। বাবা মাকে শুধু ভালোবাসতেন না, যথেষ্ট শ্রদ্ধাও করতেন। আমার বেশ মনে পড়ে কলকাতায় আসার পর বাবা একদিন আমাকে বলেছিলেন, জন্ম জন্ম তপস্যা করার ফলেই তোর মাকে আমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছি। বাইরের লোক ওর রূপ দেখে স্তম্ভিত হয় কিন্তু ওর গুণের কাছে রূপ কিছুই না।
মা এমনই দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন যে বাবা সর্বস্ব কিছু পণ করেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না। মা চলে গেলেন। আমি তখনই জানতাম, বাবা এই আঘাত সহ্য করতে পারবেন না। আমার বি. এ. পরীক্ষা শেষ হবার দিন তিনেক পরেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। বাহাত্তর ঘণ্টা পার হবার পর হেমন্তকাকু বললেন, আর ভয় নেই। বিপদ কেটে গেছে।
আমার অদৃষ্টের মহাকাশে মুহূর্তের জন্য সূর্য উঁকি দিলেও আবার সঙ্গে সঙ্গে মেঘে ঢাকা পড়ল। বাবাও চলে গেলেন।
সে-সব দিনের কথা বেশি লিখে তোমার মনে দুঃখ দেব না। তুমি সহজেই আমার অবস্থা বুঝতে পারছ। আমি ভাবতে পারিনি এমন অকস্মাৎ আমার জীবনের সব আলো নিভে যাবে। হেমন্তকাকুর বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুক্তকণ্ঠে বলব, সেই অন্ধকার। অমানিশার রাত্রিতে আর কোনো আত্মীয় বন্ধু নয়, শুধু উনিই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
কাকু আমাকে বললেন, ডোন্ট ফরগেট কবিতা, আমি এখনও বেঁচে আছি। তোমার কিছু ভাবতে হবে না। তুমি এম. এ. পাশ কর, ডক্টরেট হও; তারপর ভেবে দেখা যাবে।
সত্যি আমাকে কিছু ভাবতে হল না। আমাদের কালীঘাটের বাড়িটা পঁচাত্তর হাজার টাকায়। বিক্রি করলেন। ফার্নিচার আর বাবার আইনের বই-পত্তর বাবার জুনিয়ারকে দেওয়া হল। আমি কাকুর দুখানা ঘরের ফ্ল্যাটে চলে গেলাম।
কাকুর ফ্ল্যাটে একটা ড্রইংরুম, একটা বেড রুম, বেডরুমের সঙ্গেই বাথরুম আর ছোট একটা স্টাডি। এ ছাড়া একটা কিচেন। কাকুর সংসার-ধর্মের ভার সালাউদ্দিন নামে একজন খানসামা-কাম-বাবুর্চির উপর। ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গার সময় কাকু সালাউদ্দিনকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তারপর থেকেই সালাউদ্দিন স্বেচ্ছায় কাকুর সংসারের ভার নিয়েছে। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে সালাউদ্দিন যখন আসে তখন কাকু ঘুমিয়ে থাকেন। ওর হাতের চা খেয়েই কাকুর ঘুম ভাঙে। ব্রেকফাস্ট খেয়ে কাকু অফিস যান। আবার লাঞ্চের সময় আসেন। রাত্রের রান্না ফ্রিজে রেখে সালাউদ্দিন আড়াইটে তিনটে নাগাদ চলে যায়। শুধু রান্নাবান্না নয়, কাকুর সংসারের সব কিছু দায়িত্বই ওর। বাজার হাট, জামা কাপড়, বিছানা বালিশ, মোটর গাড়ির তদারকি ছাড়াও হুইস্কি সোড়া এনে রাখার দায়িত্বও এই সালাউদ্দিনের।
কাকুর বেডরুমটা বেশ বড়। সুতরাং সে ঘরের এক পাশে আমার খাট আর একটা আলমারি রাখায় কারুরই কোনো অসুবিধে হল না। কাকুর ঘরেই শোবার ব্যাপারে একবার যে মনে খটকা লাগেনি, তা নয়; তবে প্রথম কথা আর কোনো শোবার ঘর ছিল না, আর দ্বিতীয় কথা, যার স্নেহ অবলম্বন করে আমি এখানে এলাম, তাকে অবিশ্বাস করা অন্যায়। পাশের স্টাডিটা আমিই নিলাম। ওখানেই পড়াশুনা করব।
তারপর একদিন কাকু নিজে আমাকে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে এম এতে ভর্তি করে দিলেন আর বললেন, এতোদিনে নিশ্চয়ই আমাকে চিনেছ। ট্রিট মি অ্যাজ এ রিয়েল ফ্রেন্ড, কোনো ব্যাপারে দ্বিধা করবে না।
আমিও সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি আপনার ফ্ল্যাটে থাকছি বলে আপনিও কোনো ব্যাপারে দ্বিধা করবেন না।
কাকু বললেন, সন্ধের পর দু এক পেগ হুইস্কি খাই, তা তো তুমি জানো। সুতরাং আর কোনো ব্যাপারে তো আমার দ্বিধা হবার কোনো কারণ নেই।
হুইস্কি খাবার কথা বলছি না। আপনার জীবনধারণের অন্য কোনো ব্যাপারেও দ্বিধা করবেন।
না, না, কোনো ব্যাপারেই দ্বিধা সঙ্কোচ নেই।
আমার নতুন জীবন বেশ ভালো ভাবেই শুরু হল। সালাউদ্দিন আসার আগেই উঠে পড়ি। স্নান সেরে বেরুতেই সালাউদ্দিন আসে। চা খাই। কারুর সঙ্গে একটু কথা বলি। খবরের কাগজ পড়ি। তারপর একটু পড়াশুনা করি। পড়াশুনা করতে করতেই সামান্য কিছু খাই। তারপর কাকু অফিস বেরিয়ে যাবার পরই খেতে বসি! খেয়ে দেয়েই ইউনিভার্সিটি। বেরুবার সময় সালাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করি, চাচা, কিছু আনতে হবে?
এমনি কিছু আনতে হবে না, তবে সাহেবের গেঞ্জি কিনে আনলে ভালো হয়।
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট মার্কেট থেকে কাকুর জন্য চারটে গেঞ্জি কিনেই বাড়ি আসি। ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে কোনো দিন সালাউদ্দিনের দেখা পাই, কোনোদিন পাই না। একটু বিশ্রাম করি। হয়তো কোনো পত্র পত্রিকা একটু উল্টে দেখি। কোনো কোনোদিন দু-একজন বান্ধবী এসেও হাজির হয়। সবাই মিলে আড্ডা দিই, চা-টা খাই।