সব ভদ্র শিক্ষিত লোকেই পারে।
আমি এবার দৃষ্টিটা নীচের দিকে করে নিজের মনে মনে ওর কথাগুলো ভাবি। দু এক মিনিট নিজের মনে মনেই তর্ক করি কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারি না।
এবার উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ভাবছ, কবিতা?
বিশেষ কিছু না।
আমার হুইস্কি খাবার কথা ভাবছ?
এবার আমি ওর দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা কাকু, আপনি হুইস্কি খান?
উনি মাথা নেড়ে বললেন, রাত্রে খাওয়া দাওয়ার আগে একটু খাই।
রোজ?
হ্যাঁ।
খাওয়া দাওয়ার আগে কেন খান?
তাতে শরীর ভালো হয়।
এবার আমি আবার ভাবি। কোনো প্রশ্ন করি না, কিন্তু উনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনোদিন আমাকে মাতাল হতে দেখেছ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না।
উনি এবার হাসতে হাসতে বললেন, আজ তো তুমিও একটু হুইস্কি খাবে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললাম, না না, কাকু, আমি ও সব খাব না।
উনি আবার দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বললেন, আচ্ছা পাগলি মেয়ে! হুইস্কি খাবার নাম শুনেই প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়।
আমি একটু হেসে বললাম, মদ খেলে আমি মরেই যাব।
আর যদি না মরে যাও, তাহলে…
তাহলে মাতাল হব।
যদি মাতাল না হও।
তাহলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব।
যদি তা-ও না হও?
মোট কথা, মারাত্মক কিছু হবেই।
কিছু মারাত্মক হবে না।
তবে কি মদ খাবার পরও আমি স্বাভাবিক থাকব?
একশোবার স্বাভাবিক থাকবে।
তাহলে মদ খেয়ে লাভ?
মনটা খুশিতে ভরে যাবে।
হেমন্তকাকু আর কথা না বলে হুইস্কির বোতল, ফ্লাস্ক, গ্লাস, সোডার বোতল নিয়ে বসলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, আমি একটু খাই?
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম।
তোমার আপত্তি থাকলে আমি বাইরের প্যাসেজে দাঁড়িয়ে খেয়ে আসছি।
না, না, আপনি বাইরে যাবেন কেন? অসুবিধে হলে আমিই একটু বাইরে দাঁড়াব।
তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? তোমাকে বাইরে রেখে আমি এখানে বসে বসে ড্রিঙ্ক করব?
আমি বাইরে যাবই, তা তো বলছি না।
উনি একটা গ্লাসে হুইস্কি আর সোডা মিশিয়ে আমার মুখের সামনে ধরে বললেন, চিয়ার্স! ফর আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ!
কাকু গ্লাসে চুমুক দিতেই আমি স্তম্ভিত হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
০৫. এর আগের চিঠিটা পড়ে
এর আগের চিঠিটা পড়ে নিশ্চয়ই মনে হয়েছে, সে রাত্রে ট্রেনের মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিল। না, সে রকম কিছু হয়নি। তবে দু পেগ খাবার পরই কাকু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি কবিতা আমি কি মাতাল হয়েছি?
আমি বিজ্ঞের মতো গম্ভীর হয়ে বললাম, কোনো ভদ্র-শিক্ষিত লোক মাতাল হয় না। আমার কথা শুনে কাকু হো হো করে হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর হুইস্কির গেলাসটা আমার মুখের সামনে ধরলেন, তুমি একটু খাবে না?
না কাকু, প্লিজ?
কেন? ভয় কী?
ভয় কেন করবে? ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করছে না বোলো না। কিছুটা ভয় আর কিছুটা সঙ্কোচের জন্যই তুমি খাচ্ছ না।
কোনো ব্যাপারেই আমার ভয় বা সঙ্কোচ নেই।
কাকু মিট মিট করে হাসতে হাসতে বললেন, বিশ্বাস করি না।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সময় এলেই প্রমাণ পাবেন।
কাকু গেলাসের বাকি হুইস্কিটা একবারে গলায় ঢেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাস না।
একশোবার আপনাকে ভালোবাসি।
কিন্তু তার তো কোনো প্রমাণ পাচ্ছি না।
শুধু হুইস্কি খেলেই বুঝি আপনি তার প্রমাণ পাবেন?
তা বলছি না; তবে যদি ভালোবাসতে তাহলে এতবার অনুরোধ করার পর নিশ্চয়ই অন্তত এক পেগ খেতে।
তারপর হুইস্কি খেয়ে যদি মাতাল হই?
এমন ভাবে খাবে যাতে নেশা হবে না কিন্তু মৌজ হবে।
ঠিক আছে, জানা থাকল।
.
বেশি দিন নয়, মাত্র তিন দিন আমরা পুরী ছিলাম। সত্যি বলছি ভাই, এর আগে এমন আনন্দ কখনও হয়নি। হেমন্তকাকু বয়সে অনেক বড় হলেও সত্যি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলেন।
কলকাতা ফেরার পর আমাকে আনন্দে, খুশিতে ভরপুর দেখে মা জিজ্ঞাসা করলেন, খুব আনন্দ করেছিস, তাই না?
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, হ্যাঁ মা। খুব আনন্দ করেছি।
খুব ঘুরেছিস?
খুব ঘুরেছি, খুব খেয়েছি, খুব সাঁতার কেটেছি, খুব ঘুমিয়েছি, খুব মজা করেছি।
কিছু আর বাকি রাখিসনি।
হেমন্তকাকু বাবাকে বললেন, তোর চাইতে তোর মেয়ের সঙ্গে আমার বেশি বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, বিয়ে-টিয়ে যখন করলি না তখন আমার মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেই জীবনটা কাটিয়ে দে।
মার জন্য বাবা কোর্টে ছাড়া কোথাও বেরুতেন না। সব সময় বাড়িতেই থাকতেন। তাই আমি মাঝে মাঝে কাকুর সঙ্গে কলকাতার মধ্যে এদিক ওদিক বা সিনেমা থিয়েটারে যেতাম। কখনও কখনও ছুটির দিন আমি কাকুর ফ্ল্যাটেই সারাদিন কাটাতাম। মাঝে মাঝে আমার দু-একজন বন্ধুও কাকুর ওখানে যেতো। তারপর হয়তো আমরা সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে যেতাম।
তারপর মার শরীর খারাপ হতে শুরু করল। মাঝে মাঝেই কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখি বাবা কোর্টে যাননি। মার বিছানার ধারেই বসে আছেন। আমিও মার পাশে বসি। মার মাথায়, বুকে হাত বুলিয়ে দিই। মা বলেন, তুই চান-টান করে আয়।
আমি বলি, একটু পরে যাব।
মা আমার হাত দুটো নিজের দুর্বল হাতের মধ্যে নিয়ে বলেন, না, যা। অনিয়ম করলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। মা একসঙ্গে বেশি কথা বলতে পারতেন না বলে একটু থেমে বলতেন, আমি অসুস্থ হয়েছি বলে তোরা কেন অনিয়ম করবি? আমি আর কোনো কথা না বলে উঠে যেতাম।