আমি একটু নীচু হয়ে ওকে প্রণাম করতে যেতেই উনি তাড়াতাড়ি দুহাত দিয়ে আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, থাক, থাক, ও সব ফর্মালিটির দরকার নেই।
সেদিন কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেই উনি চলে গেলেন। এর পর থেকে উনি মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। কখনও কখনও আমাকে নিয়ে এদিক-ওদিক বেড়াতেও যেতেন। সত্যি হেমন্তকাকুকে বেশ লাগত। ওরা একটা ছোট্ট মরিস এইট গাড়ি ছিল। স্কুলের গণ্ডী পেরুবার আগেই আমি ওর উৎসাহে গাড়ি চালানো শিখি। সত্যি, সেদিনের উত্তেজনার কথা ভুলব না। মনে হল হেমন্তকাকু যেন আমার হাতে আকাশের চাঁদ এনে দিলেন।
পরের বছর আমি কলেজে ভর্তি হবার পরই হেমন্তকাকু একদিন বার মার সামনে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বল কবিতা, কি চাই?
কী আর চাইব!
না, না, কিছু চাইতেই হবে।
অনেকবার বলার পরও যখন আমি কিছু বললাম না, তখন উনি বললেন, চল, তোমাকে পুরী ঘুরিয়ে আনি।
আমি কিছু বলার আগেই বাবা বললেন, আমিও ভাবছিলাম সবাইকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু ডাক্তার বারণ করছেন বলে বেরুতে পারছি না।
সঙ্গে সঙ্গে মা বললেন, আমরা যখন যেতে পারছি না তখন খুকি বরং ওর কাকুর সঙ্গে ঘুরে আসুক।
বাবা বললেন, তাতে আমার কি আপত্তি?
হেমন্তকাকু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়িতে যাবে? নাকি ট্রেনে?
মা বললেন, না, না, গাড়িতে অত দূর যেতে হবে না।
দিন কয়েক পর আমি হেমন্তকাকুর সঙ্গে পুরী রওনা হলাম। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি। ফার্স্ট ক্লাস কুপে রিজার্ভ করা রয়েছে। মালপত্র রাখার পরই উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি কবিতা, ঠিক আছে তো?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমার কাকুর প্ল্যানিং-এ কী কোনো ত্রুটি থাকতে পারে?
উনি হাসতে হাসতে বললেন, আমি শুধু তোমার কাকু না, বাট অলসো ইওর ফ্রেন্ড।
আমি সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানালাম, দ্যাটস রাইট।
ট্রেন ছাড়ার তখনও দেরি ছিল। উনি বললেন, তুমি বস, আমি আসছি।
পনেরো বিশ মিনিট পরেই উনি দুটো সোডার বোতল নিয়ে আসতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কী দু বোতল সোডা দিয়ে কী করবেন?
একটু চাপা হাসি হেসে হেমন্তকাকু বললেন, কেন? দুজনে খাব।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমার কি অম্বল হয়েছে যে সোডা খাব?
হেমন্তকাকু আর কিছু না বলে বাথরুম থেকে জামা-কাপড় বদলে নীচের বার্থে আমার বিছানা পেতে দিলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী শাড়ি-টাড়ি বদলে নেবে?
হ্যাঁ। তাহলে যাও। বাথরুম থেকে ঘুরে এসো।
আমি বাথরুম থেকে আসতে আসতেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কাকু আমার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন, এবার বস। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাক।
বসলাম।
এবার উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী এই প্রথম পুরী যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
তোমার সমুদ্র ভালো লাগে, না পাহাড়?
দু-ই, কিন্তু কোনোটাই দেখা হয়নি।
ঠিক আছে। এরপর তোমাকে নিয়ে দার্জিলিং বা সিমলা যাব।
আপনি খুব ঘুরে বেড়ান, তাই না কাকু?
উনি একটু হেসে আমার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বললেন, হাজার হোক ব্যাচেলার। সংসার-টংসারের ঝুট-ঝামেলা তো নেই। তাই সুযোগ পেলেই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়ি।
সংসারের ঝামেলায় না জড়িয়ে পড়াই ভালো।
সে কী? তুমিও কী বিয়ে করবে না?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বিয়ে-টিয়ে করা আমার একটুও ভালো লাগে না।
তাহলে কি করবে?
কী আর করব? পড়াশুনা করার পর চাকরি করব।
একলা একলা থাকবে?
একলা থাকব কেন! বাবা মার সঙ্গে থাকব।
কিন্তু বাবা মা তো চিরকাল থাকবেন না।
তখন আর কি করব? একলাই থাকব।
বিয়ে না করে থাকতে পারবে?
খুব পারব।
উনি একবার ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হয় না তুমি বিয়ে না করে থাকতে পারবে।
আমি একটু অবাক হয়ে কাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, পারব না কেন?
উনি হাসতে হাসতে আমাকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, তোমার মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে বিয়ে না করে থাকা খুব মুশকিলের।
আমি সুন্দরী?
কাকু চোখ দুটো বড় করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সুন্দরী না?
মোটেও না।
একশোবার, হাজারবার তুমি সুন্দরী।
আপনার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।
এ ব্যাপারে তর্ক না করাই ভালো।
কিন্তু সুন্দরী হলেই যে বিয়ে করতে হবে, এমন কোনো কারণ নেই।
কাকু চাপা হাসি হাসতে হাসতে বললেন, কারণ আছে।
কী কারণ?
ছেলেদের উৎপাতে পাগল হয়ে যাবে!
আমি লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, আমাকে কেউ উৎপাত করবে না।
ঠিক আছে। দেখা যাবে আমি ঠিক নাকি তুমি ঠিক।
দেখবেন।
.
কাকু হঠাৎ নেমে দাঁড়িয়েই বললেন, এবার শুরু করা যাক, কি বল?
কি শুরু করা যাক?
একটু আনন্দ।
আনন্দ? আমি অবাক হয়ে ওর দিকেই তাকাই।
হেমন্তকাকু অত্যন্ত সহজ ভাবে বললেন, দুজনে বেড়াতে যাচ্ছি একটু হুইস্কি খাব না?
মদ। আমি প্রথম চমকে উঠলাম।
উনি দুহাত দিয়ে আমার মখখানা তুলে ধরে বললেন, সারা পৃথিবীর লোক হুইস্কি খায়। হুইস্কি খাওয়া অন্যায় নয়, কিন্তু মাতাল হওয়া অন্যায়।
কিন্তু মদ খেলেই তো লোকে মাতাল হয়।
ডোন্ট সে মদ, সে হুইস্কি।
হুইস্কি খেলেও তো মাতাল হবে।
কোনো জিনিসই বেশি খাওয়া ভালো নয়। যে কোনো জিনিস বেশি খেলেই শরীর খারাপ হয়, তাই না?
হ্যাঁ।
বেশি হুইস্কি খাওয়াও খারাপ। প্রথম কথা মাতাল হবে, দ্বিতীয় কথা শরীর খারাপ হবে।
কিন্তু নেশা কি কেউ হিসেব করে করতে পারে?