আমি কিছু জিজ্ঞাসা করতাম না কিন্তু বেশ বুঝতে পারতাম, গিয়াসুদ্দীন চাচার মনে অনেক দুঃখ। আর বুঝতাম, উনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন।
তুমি কলকাতার ছেলে। পূর্ব বাংলায় যাওনি। বর্ষকালে পূর্ববাংলার রূপ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেই বর্ষা-বাদলের দিনেও গিয়াসুদ্দীন চাচা আমাকে দেখতে আসবেনই।
আমি হয়তো বলতাম, চাচা, এই বর্ষায় কেউ আসে?
গিয়াসুদ্দীন চাচা একমুখ হাসি হেসে জবাব দিতেন, সেই অঘ্রাণের আগে তো বর্ষা থামবে। তাই বলে কি এই কমাস তোমার মখখানা দেখব না?
দাদু আমাকে বলেছিলেন, গিয়াসুদ্দীন চাচার একমাত্র মেয়ে কলেরায় মারা যায় এবং পরের বছর ওর জন্মদিনেই আমার জন্ম হয়।
সেই সে সময় আমি স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় একটা বই পুরস্কার পাই। দাদুর কাছে সে খবর শুনে গিয়াসুদ্দীন চাচার কি আনন্দ! হাতে সময় থাকলেই বলতেন, দিদি, আমাকে একবার কাজলাদিদি কবিতাটা শুনিয়ে দাও তো-যেটার জন্য তুমি মেডেল পেয়েছ।
গিয়াসুদ্দীন চাচার প্রশংসায় আমি এমনই উৎসাহিত হয়েছিলাম যে যখন-তখন যাকে-তাকে কাজলাদিদি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম। ওই এক কবিতা হাজার বার শুনতে শুনতে বাড়ির সবাই পাগল হয়ে যেতেন কিন্তু গিয়াসুদ্দীন চাচার কথা মনে করে আমি মা বা দিদার হাসাহাসিকেও গ্রাহ্য করতাম না।
তারপর একদিন সদরঘাটে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরও আমাদের লঞ্চ এলো না। আস্তে আস্তে রাত হল। রাতের পাতলা অন্ধকার গাঢ় হল, কিন্তু গিয়াসুদ্দীন চাচা লঞ্চ নিয়ে ফিরলেন না। অনেক রাত্রে সর্বনাশের খবর এলো। আমি আর জীবনে কোনোদিন কাজলাদিদি কবিতা আবৃত্তি করতে পারলাম না।
এরপর মাস খানেক বিছানায় শুয়েই দাদু বেঁচে ছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। বছরখানেক ঘুরতে না ঘুরতেই দিদাও দাদুর কাছে চলে গেলেন।
আমার হোট দুনিয়া হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেল।
আমার দাদু নিজে বিশেষ লেখাপড়া করতে পারেননি বলে বাবাকে এম. এ. বি এল. পর্যন্ত পড়ান। একে দাদু দিদার মৃত্যু তারপর ঢাকা কোর্টে ওকালতি করে বিশেষ সুবিধে না হওয়ায় বাবা ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। আসার পর জানলাম মার ক্যান্সার হয়েছে এবং তার চিকিৎসার জন্যই বাবা ঢাকা ছেড়ে কলকাতা এসেছেন।
কলকাতায় আসার পর প্রায় বছর দুই মা মোটামুটি ভালোই ছিলেন। নিজেই সংসারের কাজকর্ম করতেন। আমি স্কুল থেকে ফিরলে ঘন্টাখানেক গল্প করবেনই। তারপর বাবা কোর্ট থেকে ফিরলেই বলতেন, অমন করে তাকিয়ে দেখার কোনো কারণ হয়নি। আমি ভালোই আছি।
বাবা তার সমস্ত উৎকণ্ঠা লুকিয়ে হাসি মুখে বলতেন, ভালো থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই ভালো থাকবে।
.
আমার বাবা অত্যন্ত সৎ ও শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি আপন মনে নিজের কাজকর্ম-লেখাপড়া করতেন। তাইতো দাদু বাবাকে ব্যবসা-বাণিজ্যে না টেনে স্বাধীন পেশায় দেন, কিন্তু অমন লাজুক লোকের পক্ষে ওকালতিতেও সুবিধে করা সহজ নয়। বাবাকে কোনোদিন তাস-পাশা খেলতে বা কোথাও কারুর সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখিনি। কোর্টে যাওয়া-আসা ছাড়া সবই সময়ই নিজের ঘরে বসে পড়াশুনা করতেন। দাদু থাকতে আমি বাবার কাছে যেতাম না, কিন্তু কলকাতায় আসার পর আমাদের সবকিছু বদলে গেল। বাবার কাজকর্মের চাপ অত্যন্ত বেড়ে গেলেও বাবা আমার অনেক কাছের মানুষ হলেন।
গিয়াসুদ্দীন চাচা আর দাদুকে হারানোর পর এই পৃথিবীকে আমার মরুভূমি মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম ওই ক্ষণস্থায়ী সুখের স্মৃতি রোমন্থন করেই আমাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে, কিন্তু না, কলকাতায় আসার পর অসুস্থ মা আর কর্মব্যস্ত বাবা আমাকে স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলেন। আমার পৃথিবী আবার সবুজ, সুন্দর হয়ে উঠল।
আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।
০৪. কলকাতা আসার মাস ছয়েক পরের কথা
কলকাতা আসার মাস ছয়েক পরের কথা। সেদিন বাবার কোর্ট বন্ধ হলেও আমার স্কুল খোলা ছিল। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই দেখি বাবা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মা, বাবা কার সঙ্গে অত গল্প করছেন?
মা হেসে বললেন, উনি ওর বন্ধু।
বাবার বন্ধু! আমি অবাক হয়ে বললাম।
হ্যাঁ। ওরা একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে ল পড়তেন।
এর আগে কী উনি আমাদের এখানে এসেছেন?
না। আজ ডাঃ রায়ের ওখানে হঠাৎ দুই বন্ধুর দেখা হয়েছে।
বাবার বন্ধুর কি নাম? হেমন্ত মজুমদার। উনিও কি প্র্যাকটিস করেন?
না। উনি একটা সাহেবী কোম্পানিতে ভালো চাকরি করেন।
তুমি ওকে আগে থেকেই চিনতে?
আমার বিয়ের পরই একবার শিয়ালদা দেখা হয়েছিল।
আমি স্কুলের কাপড়-চোপড় ছেড়ে খেতে বসলে মা বললেন, তোর বাবার কাছে শুনেছি হেমন্তবাবু খুব আমুদে লোক। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় সারা ক্লাসের ছেলেদের জমিয়ে রাখতেন। আজ দেখে মনে হল, উনি সেই রকমই আছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি থাকেন কোথায়?
বোধহয় এলগিন রোডের কাছাকাছি। একটু থেমে মা প্রায় আপন মনেই বললেন, ভদ্রলোক বিয়ে-টিয়ে না করে বেশ কাটিয়ে দিলেন।
খেয়ে-দেয়ে আমি আমার ঘরে যেতে না যেতেই বাবা ডেকে পাঠালেন। গেলাম। বাবা বললেন, আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম…
হেমন্তবাবু আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, এ ব্যাচেলার কাকু তোমারও বন্ধু।