ড্রিঙ্ক!
ইয়েস। ওয়ান ফর দ্য রোড।
গাড়ি থেকে নামতে গিয়েই দুটো পা টলমল করে উঠল। মিঃ মুখোপাধ্যায় তাড়াতাড়ি আমার একটা হাত ধরতেই সামলে নিলাম। এলিভেটরে উপরে উঠে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময়ও উনি আমাকে আলতো করে ধরে নিয়ে গেলেন।
তারপর মিঃ মুখোপাধ্যায়কে ড্রিঙ্ক অফার করতেই উনি বললেন, আপনাকেও সঙ্গ দিতে হবে।
না, না, আমাকে আর অনুরোধ করবেন না। আর এক পেগ খেলেই আমি বেসামাল হয়ে পড়ব।
এখন আর ভয় কী? এখন তো নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে গেছেন।
তা ঠিক কিন্তু…
কোনো কিন্তু নয়। আমি একা একা ড্রিঙ্ক করব না। জাস্ট এ পেগ ওনলি। আপনি শুয়ে পড়বেন; আমিও চলে যাব।
কী আর করব? এ পেগ খেতেই হলো। মিঃ মুখোপাধ্যায় কোনো অশালীন ব্যবহার করলেন। বিদায় নেবার পূর্ব মুহূর্তে শুধু আমার চিবুকে একটা চুমু খেলেন। আমি সকৃতজ্ঞ চিত্তে ওকে ধন্যবাদ জানালাম।
.
বাদল-ঋতু না থাকায় উনিই আমার একমাত্র বন্ধু হয়ে উঠলেন। দুজনেই ইউনাইটেড নেশনসএ কাজ করি। রোজ না হলেও প্রায়ই ক্যাফেটেরিয়ায় দেখা হয়। একসঙ্গে কফি খাই, গল্পগুজব করি। ওর সাহায্যে আমার ছোটখাটো সমস্যার সমাধান হয়। উইক-এন্ডে উনি আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসেন; খাওয়া-দাওয়া করেন। আমিও ওর ওখানে সারাদিন কাটিয়ে আসি।
বেশ কেটে গেল ছ সাত মাস। তারপর ওরই উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় আমি ইউ. এন. স্পেশ্যাল কমিটিতে আসি। মাইনেও বেড়ে গেল অনেক। সেই সঙ্গে সম্মান ও সুযোগ। বয়সের ব্যবধান ভুলে আমরা সত্যি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম।
তারপরের ইতিহাস শুনতে চাও? হাজার হোক তুমি আমার আদরের ভাই; আমি তোমার দিদি। সব কথা বলতে পারব না। বোধহয় প্রয়োজনও নেই। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, মিঃ মুখোপাধ্যায় তিলে তিলে আমাকে গ্রাস করলেন। উনি ওর কামনা-বাসনার আগুনে আমাকে জ্বালিয়ে প্রায় সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়ে আমার জীবন থেকে হঠাৎ বিদায় নিলেন। আমি রাগে-দুঃখে প্রায় হতবাক হয়ে গেলাম। আত্মহত্যা করতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম। মনে হলো, ওই একটা পশুর উপর অভিমান করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার কোনো যুক্তি নেই, কোনো সার্থকতা নেই।
পুরুষদের উপর তীব্র বিদ্বেষ আর ঘৃণা নিয়ে আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চাইলাম। কিন্তু ভাই, এই পুরুষশাসিত সমাজে তো বেশি দিন পুরুষদের থেকে দূরে থাকা যায় না। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, পুরুষদের কাছে মেয়েদের যেতেই হবে। না যেয়ে কোনো উপায় নেই। আমার মতো নিঃসঙ্গ ও চাকুরিজীবি মেয়ের পক্ষে তো পুরুষদের এড়িয়ে চলা নিতান্তই অসম্ভব।
ভাই রিপোর্টার, তোমার কাছে মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব, আমার জীবনে আরো অনেকে এসেছেন। দু, একজন প্রথিতযশা ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও কুটনীতিবিদ আমার রূপ যৌবনের কাছে এমন নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন যে ভাবতে গেলেও আমি নিজেই বিস্মিত হয়ে উঠি। শুধু তোমার কাছেই বলেছি, স্বীকার করছি, কখনও কখনও আমার দেহ ও মন এমন বিদ্রোহ করে উঠেছে যে আমি স্বেচ্ছায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি সদ্য পরিচিত বন্ধুদের কাছে।
.
একটা পুরনো কথা মনে পড়ছে। অনেকদিন আগে মার এক দূর সম্পর্কের মাসি আমাকে আপাদ-মস্তক দেখার পর বলেছিলেন, হারামজাদী, তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন দিদি, তুমি একথা বলছ?
ওরে হারামজাদী, তোর যা রূপ, তোর যা শরীর, তাতে কী পুরুষরা তোকে শান্তিতে থাকতে দেবে?
বাজে কথা বলল না।
ওরে হতাভাগী, মেয়েদের এমন সর্বনাশা রূপ, এমন ডাগর-ডোগর দেহ থাকা যে কী অভিশাপ, তা পরে বুঝবি।
আমার সেই দিদিমার কথাটা আমি সেদিন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু পরবর্তীকালে আমি মর্মে মর্মে বুঝেছি, মনে মনে স্বীকার করেছি, মেয়েদের রূপ-সৌন্দর্য সত্যি মহা অভিশাপ।
সেই বেশ কবছর আগে কাকাবাবু থেকে শুরু করে অনেক পুরুষের সঙ্গেই অনেক খেলাই খেলতে হলো। অনেকে আমাকে শিকার করলেন; আমিও কাউকে কাউকে শিকার করে মনের জ্বালা, দেহের দাবি মিটিয়েছি। সত্যি বলছি ভাই, আর ভালো লাগছে না। এখন আমার দেহে মনে নতুন জ্বালা, নতুন স্বপ্ন, নতুন দাবি; এখন আর আমার এই দেহ কোনো কামনা-জর্জরিত। হিংস্র পশুর কাছে বিলিয়ে দিতে পারি না, পারব না কিন্তু এই এত বড় পৃথিবীতে এমন একজন পুরুষও কী নেই যে আমাকে আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে নিয়ে আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিতে পারে? আমাকে সমস্ত অকল্যাণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে? রাতের অন্ধকারে আমাকে তার বলিষ্ঠ দুটো হাতের মধ্যে, বুকের কাছে নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিতে পারে?
তুমিই বলো ভাই, এই পৃথিবীতে কী এমন একজনও উদার মহৎ পুরুষ নেই যিনি আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেন? আমাকে অন্তত একটা সন্তানের জননী হবার গৌরব দান করতে পারেন?
মনে হয়, এই মাটির পৃথিবীতে এমন উদার, মহৎ পুরুষ নেই। এই সংসারের চরম ব্যাভিচারি পুরুষও সতী-সাবিত্রীর মতো স্ত্রী আশা করেন। তাই তো আমি জানি, আমার সিথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেবেন না কেউ; আমাকে উপভোগ করার মতো পুরুষের অভাব নেই কিন্তু আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, সন্তানের মা হবার গৌরব দান করতে সবারই কুণ্ঠা, সবারই দ্বিধা।