নবেন্দুবাবু চমকে উঠলেন। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভাইপোকে আপনি কাছেই রেখে দিলেন?
হ্যাঁ, ও আমার কাছেই সব সময় থাকে।
সব সময় মানে?
ভদ্রমহিলা আবার একটু হাসেন। বলেন, আমার বৌদিও চাকরি করেন; তাছাড়া একটু বেশি ঘোরাঘুরি পছন্দ করেন।
এবার নবেন্দুবাবুও একটু হেসে বলেন, বুঝেছি।
ভদ্রমহিলাও হাসেন। বলেন, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের চেহারাটা বদলালেও চরিত্রটা বদলায়নি। যাক, আমার কথা বাদ দিন। আপনার কথা বলুন।
কী জানতে চান বলুন।
হরিদ্বারে কেন এলেন?
তীর্থস্থানে কেন এসেছি; তাও বলতে হবে?
আপনি তো তীর্থ করতে আসেননি। সারাদিন তো ঘরের মধ্যে শুয়ে বসে আবৃত্তি করেই কাটিয়ে দিচ্ছেন।
কোনোমতে কিছু সময় কাটাবার জন্যই এখানে এসেছি। তা আপনি কি করে দিন কাটাচ্ছেন।
গঙ্গস্নান, রান্নাবান্না, দিবানিদ্রা, গঙ্গারতি…
আপনি রোজ গঙ্গায় স্নান করেন?
হ্যাঁ। আপনি গঙ্গায় স্নান করেননি?
না। কেন, হরিদ্বারে এলেই বুঝি গঙ্গাস্নান করতে হয়?
তা নয়, তবে এখানকার গঙ্গায় স্নান করার একটা আলাদা আনন্দ আছে।
তাই নাকি?
নিশ্চয়ই। এবার ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, কাল কালে আপনাকে গঙ্গায় নিয়ে যাব। দেখবেন, স্নান করে কি আরাম।
নবেন্দুবাবু হাসেন। কিছু বলেন না।
ভদ্রমহিলা এবার বললেন, আমাদের এই ধর্মশালা থেকে গঙ্গা এত কাছে যে আমার তো মনে হয়, সময় পেলেই গঙ্গায় স্নান করে আসি।
গঙ্গাস্নান করতে আপনার এত ভালো লাগে?
গঙ্গাস্নান করতে ভালো লাগে না; তবে এখনাকার গঙ্গায় স্নান করতে সত্যি ভালো লাগে।
আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, পরদিন গঙ্গায় স্নান করেছিলেন?
নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, পরদিন ভোরবেলায় উমা যখন ডাকল, তখন আর না করতে পারলাম না।
গঙ্গাস্নান করে কেমন লাগল?
নবেন্দুবাবু আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, গঙ্গাস্নান করে সারা শরীরটা জুড়িয়ে গেল ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উমাকে দেখে আমার সারা শরীরে আবার আগুন জ্বলে উঠল।
কেন?
ওখানে মেয়ে পুরুষের স্নান করার কোনো আলাদা ঘাট নেই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, নবেন্দুবাবু একটু থামলেন; যেন হরিদ্বারের গঙ্গাস্নানের দৃশ্যটা একবার ভালো করে মনে করে নিলেন। তারপর বললেন, উমা ভাইপোকে স্নান করিয়ে আমার পাশেই স্নান করতে নামল। তারপর স্নান করে দুজনেই একসঙ্গে উঠলাম।
প্রশ্ন করলাম, তারপর?
ভেজা কাপড়ে ওকে দেখেই আমি চমকে উঠলাম। তারপর ওই অবস্থায় ওর পাশাপাশি ধর্মশালা পর্যন্ত আসতে আসতে…
উনি কাপড় বদলে নিলেন না কেন?
ঘাটের ওপর অত লোকের সামনে ও কাপড় বদলাতো না। গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে ধর্মশালায় এসেই…।
তারপর বুঝি গঙ্গাস্নানের ব্যাপারে আপনিও খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন?
শুধু গঙ্গাস্নানের ব্যাপারে নয়, সব ব্যাপারেই অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে উঠলাম।
নবেন্দুবাবুর কথায় কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও প্রশ্ন করলাম, সব কিছু ব্যাপারে মানে?
উনি একটু হেসে বললেন, উমার দাদা-বৌদি কেদার-বদ্রী ঘুরে আসার আগেই আমাদের নাটক জমে উঠল।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই উনি বললেন অবাক হচ্ছ কেন? যে বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে, সে কী এমন শিকার ছেড়ে দিতে পারে?
কিন্তু বাঘিনী?
তার অবস্থাও তো আমারই মতো।…
কিন্তু…
উনি একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, জোয়ারের জলে ওসব কিন্তু কোথায় যে চলে গেল, তা কেউই টের পেলাম না।
নবেন্দুবাবু এবার চুপ করে যান। কিছু বলেন না। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি প্রশ্ন করলাম, কী হল? চুপ করে গেলেন কেন? তারপর কী হল?
উনি খুব জোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। শুধু জেনে রাখ, সত্যি আমি উমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, ও নতুন করে বেঁচে উঠুক, কিন্তু ও কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হল না।
কেন?
বিধবা হবার পর বিয়ে করার জন্য মনের যে জোর চাই, তা ওর ছিল না।
আমি আর কোনো প্রশ্ন করি না। চুপ করে থাকি।
নবেন্দুবাবু বললেন, উমা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মনে হল, এ তো আরেক শিখারাণী। পর পর দুবার আঘাত পেয়ে আমিও ওদের মতো ব্যাভিচারী হয়ে উঠলাম।
এবারও আমি কোনো প্রশ্ন করি না।
উনি বললেন, তুমি বিশ্বাস কর কবিতা, ওদের দুজনের নোংরামির জন্যই আমিও নোংরা হয়ে গেলাম। এখন এতই খারাপ হয়ে গেছি যে আর ভালো হতে ইচ্ছা করে না। বোধহয় সম্ভব নয়।
জানো রিপোর্টার, নবেন্দুবাবু দেশে ফিরে যাবার দিন ওরলি এয়ারপোর্টে আমাকে বলেছিলেন, কবিতা, তোমার কাছেই প্রথম হেরে গেলাম, কিন্তু তবু মনে কোনো অতৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরছি না। জীবনে যে কোনো প্রয়োজনের দিনে আমাকে মনে করলে আমি সত্যি খুশি হব।
২১. কোনো পুরুষের সঙ্গেই বিশেষ ঘনিষ্ট
সত্যি বলছি, আমি কোনো পুরুষের সঙ্গেই বিশেষ ঘনিষ্ট হতে চাই না কিন্তু এমনই অদৃষ্ট যে বার বার বহু পুরুষেরই সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হতে হয়েছে আমাকে। তোমার মতো দু চারজনের কথা আলাদা। তোমার মতো একজনকে কাছে পেলে তো আমি ধন্য হয়ে যেতাম কিন্তু তা কী আমার কপালে সম্ভব?
যাই হোক নবেন্দুবাবু চলে যাবার পর সত্যি মন খারাপ হয়ে গেল। এই সংসারে শুধু পুরুষরাই মেয়েদের ক্ষতি করে না। মেয়েরাও বহু পুরুষের সর্বনাশ করে। নবেন্দুবাবুর প্রতি সমবেদনা অনুভব করলাম মনে মনে। শুক্রবার বিকেলবেলায় মনে হতো, আরো কটা দিন ওকে আটকে রাখলে বেশ ভালো হতো।