আমরা কিছু বলার আগেই সুদীপ্ত বলল, ঠিক বলেছেন কমলদা।
মায়া কৃষ্ণনগরের মেয়ে। সুদীপ্তদের বাড়িও ওখানেই। সুদীপ্তর ছোড়দি আর মায়া স্কুলে একসঙ্গে পড়ত। সেই সূত্রেই এ বাড়িতে সুদীপ্তর যাতায়াত। সেদিন থেকেই যাতায়াত।
সেদিন থেকেই সুদীপ্তকে আমার বেশ লাগে। আশে পাশে যাদের দেখি, তাদের থেকে ও একটু স্বতন্ত্র। হঠাৎ ওর কথাবার্তা শুনলে মনে হবে ও যেন এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যই এই পৃথিবীতে এসেছে। সব মানুষের বিরুদ্ধেই যেন ওর অভিযোগ। বাবা-মা, ভাই-বোন। কাউকেই ও ভালোবাসে না অথচ ওদের প্রতি কর্তব্যে ত্রুটি নেই। প্রতি মাসে ফার্স্ট ন্যাশনাল সিটি ব্যাঙ্ক মারফত দেশে টাকা পাঠাবেই।
পৃথিবীর বিরুদ্ধে সুদীপ্তর অভিযোগের কারণ আছে। রেলের স্টেশন মাস্টারের ঘরে জন্মেছে। শৈশব বা কৈশোরে দারিদ্রের সঙ্গে পরিচয় হবার কোনো সুযোগ হয়নি কিন্তু যৌবনের সিংহদ্বার পেরুতে না পেরুতেই ওর বাবা রিটায়ার করলেন। এক নিমেষে সুখের সংসার কোথায় ভেসে গেল। দারিদ্রের হাহাকার উঠল চারদিক থেকে। সুদীপ্ত জানল, তার বাবার অসৎ আয়ের দৌলতেই তার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি মধুময় হয়েছিল। কি একটা বিচ্ছিরি বিস্বাদে ওর সারা মন ভরে গেল।
.
আমার অ্যাপার্টমেন্টে দু-একদিন আসা যাওয়ার পর সুদীপ্ত একদিন কথায় কথায় বলল, দেখ কবিতাদি, একটা চরম সত্য আমি মর্মে মর্মে বুঝেছি।
কী সেই চরম সত্য?
এই পৃথিবীতে টাকা ছড়াতে পারলে সবার ভালোবাসা পাওয়া যায় আর না ছড়াতে পারলে বাবা-মার স্নেহও পাওয়া যায় না।
আমি আর প্রশ্ন করি না। একটু হাসি।
না, না, কবিতাদি, হাসির কথা নয়, আমি আমার বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে দেখেছি বলেই বলছি।
আমি কোনো মন্তব্য করি না, শুধু শুনি।
সুদীপ্ত একটু উত্তেজিত হয়েই বলল, আমার বাবার অসৎ উপায়ের টাকা উপভোগ করতে মার ভালো লাগত কিন্তু বাবার দুঃখের দিনে মার ব্যবহার দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। আমার দাদা আর দুই দিদির কীর্তি শুনলে স্তম্ভিত হয়ে যাবে।
.
বিচিত্র ছেলে এই সুদীপ্ত! বাবা-মা ভাই-বোনের উপর রাগ করে এ দেশে আসার চার বছর পর কলম্বিয়া থেকে ডক্টরেট হয়। তারপর বছর দুই কানাডায় চাকরি করার পর হঠাৎ একদিন মায়ার কাছে হাজির হয়ে বলল, ছোড়দি, এখানে আর একা একা থাকতে পারছি না। তুমি আমার বিয়ে দাও।
মায়া জিজ্ঞাসা করল, বিয়ে দাও মানে? মেয়ে পছন্দ করেছিস?
মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলে তোমার কাছে আসব কেন?
মায়া প্রতিশ্রুতি দিল, সামনের জুনে দেশে ফিরে গিয়েই বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
মায়া না থাকায় সুদীপ্ত মহুয়াকে নিয়ে আমার কাছেই প্রথম উঠেছিল। ওরা দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসে। সময় পেলেই ওয়াশিংটন থেকে চলে আসে। আমাকেও যেতে হয়। আগে বিশেষ না গেলেও তুতুল হবার পর থেকে বেশিদিন ওকে না দেখে থাকতে পারি না। তুমি তো জান, এখানে অনেক কিছু পাওয়া যায় কিন্তু ছোট্ট সংসারের নিবিড় শান্তি এখানে প্রায় স্বপ্ন। ওদের ওই তিনটি প্রাণীর ছোট্ট সংসারে গেলে আমি যেন আমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাই।
সেদিন আমি নিশ্চয়ই একটু অস্বাভাবিক ছিলাম। মহুয়া সন্দেহ করেছিল আমার শরীর ঠিক নেই কিন্তু সুদীপ্ত আমার অস্বাভাবিক মনের অবস্থা ঠিকই ধরতে পেরেছিল। মহুয়াকে কিছু বুঝতে দিয়ে ও আমাকে বলল, কবিতাদি, মহুয়া আর তুতুল তোমার কাছে সপ্তাহখানেক থাকবে।
ওরা এখানে থাকলে তোর অসুবিধা হবে না?
আমার আবার কি অসুবিধে? অফিস থেকে ফিরে এসে দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে দু-এক রাউন্ড ড্রিঙ্ক করতে না করতেই সন্ধেটা বেশ কেটে যাবে।
সুদীপ্তর কথা শুনে মহুয়া আর তুতুল খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর তুতুল দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বলল, তুমি এত গম্ভীর কেন পিসিমণি? আমার ওপর রাগ করেছ?
আমি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললাম, আমি কি তোমার ওপর রাগ করতে পারি?
রাগ না করলে কেউ এত গম্ভীর হয়?
আমি ওর মুখের উপর মুখ রেখে বললাম, না বাবা, আমি আর গম্ভীর হব না।
.
জানো ভাই, সেদিন সেই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করলাম, আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাব না। আর কারুর জন্যে না হোক এই ছোট্ট অবোধ শিশুটির ভালোবাসার জন্য আমাকে বাঁচতেই হবে।
এখন তো ওসব কল্পনার বাইরে। এখন আমার জীবনের ভালো-মন্দর সঙ্গে তুমি এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছ যে তোমাকে দুঃখ দিয়ে আমি মৃত্যুর পরও শান্তি পাব না। তাছাড়া তুমিও তো একা না। তোমার জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আরও একটি মেয়ের স্বপ্ন ও সাধনা জড়িয়ে আছে। তার স্বপ্ন ভেঙে দেবার অধিকার বা সাহস আমার নেই।
আমার মনের মধ্যে অনেক তিক্ততা, অনেক দুঃখ, বেদনার ইতিহাস, অনেক ব্যর্থতার গ্লানি চাপা থাকলেও এই পৃথিবীকে আমার নতুন করে ভালো লাগছে। বুঝতে পারছি, এই পৃথিবীর সব মানুষের মন এখনও বিষাক্ত হয়নি; ঔদার্য ও ভালোবাসার অমৃতধারা ক্ষীণ হয়ে এলেও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়নি।
ভাই রিপোর্টার, যে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার জন্য একদিন পাগল হয়ে উঠেছিলাম, তোমার জন্য সেই পৃথিবীকে আমার আবার ভালো লাগছে। আমি বাঁচতে চাই, আমি ভালোবাসা চাই, আমি ভালোবাসতে চাই। তাইতো পুরনো দিনের সব ইতিহাস তোমাকে জানিয়ে আমি গ্লানিমুক্ত হতে চাই। একদিন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য সমুদ্র মন্থনে উখিত সমস্ত বিষ ধারণ করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন আর তুমি তোমার দিদির জন্য সামান্য এইটুকু বোঝা বহন করতে পারবে না?