আমি একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করি, কিনে নিলেন মানে?
নবেন্দুবাবু গেলাসে চুমুক দিয়ে আবার একটু হাসেন। বলেন, অধ্যক্ষ কন্যা শ্রীমতী শিখারাণীর সঙ্গে আমার বিবাহ হল এবং মাত্র ছ মাস পরই তিনি একটি পুত্ররত্ন প্রসব করলেন।
ছ মাসে?
হা কবিতা, ছ মাসে। গুরুদক্ষিণা দেবার জন্য আমি না জেনে গর্ভবতী শিখারাণীকেই বিয়ে করেছিলাম।
কী আশ্চর্য! কিছু আশ্চর্যের না। এই পৃথিবীতে যে যত বেশি ঠকাতে পারে সে তত বেশি বুদ্ধিমান।
তারপর কী করলেন? শিখারাণী হাসপাতাল থেকে ফেরার আগেই আমি গিরিডি ছেড়ে পালালাম।
কোথায় গেলেন? বাড়িতে?
না, না। বাবা আর শ্বশুরমশায়ের ওপর এত ঘেন্না হল যে…
বাবা কি অন্যায় করলেন?
একে অধ্যক্ষ মশায়ের মেয়ে, তার ওপর নগদ কয়েক হাজার টাকায় বাবা এমনই বশীভূত হয়ে গেলেন যে বিয়ের আগে তিনি মেয়েও দেখতে গেলেন না।
হা ভগবান!
আরো শুনতে চাও কবিতা?
আপত্তি না থাকলে বলুন।
ছাত্র জীবনে নবেন্দুবাবু লেখাপড়ার নেশায় এমনই মত্ত ছিলেন যে অধ্যক্ষ মশায়ের বাড়িতে নিত্য যাতায়াত করলেও শিখারাণীর দিকে নজর দেবার তাগিদ বোধ করেননি। নবেন্দুবাবুর মতো আরো অনেক ছাত্রই ও বাড়িতে যাতায়াত করত কিন্তু দু-একটা মৌমাছি যে শিখারাণীর জন্যই অধ্যক্ষ মশায়ের অনুগত ছিলেন, তা উনি জানতেনও না।
যাই হোক, সংসার জীবনের শুরুতেই এমন বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়ে নবেন্দুবাবু হঠাৎ একদিন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গিরিডি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। প্রথমে কিছু দিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়ালেন যত্র-তত্র। তারপর আবার অধ্যাপনা শুরু করলেন। প্রথমে আগ্রা, তারপর লুধিয়ানা। কয়েক মাস লুধিয়ানায় থাকার পর ফিরোজপুর। না, ওখানেও বেশি দিন থাকতে পারলেন না। চলে গেলেন লক্ষ্মৌ; লক্ষ্মৌ থেকে কাশী।
বিদ্বান, বুদ্ধিমান, সুপুরুষ নবেন্দুবাবুর ওপর নজর পড়ল প্রবীণ অধ্যাপক প্রমোদ মিত্তিরের। এক রবিবার সকালে উনি হঠাৎ নবেন্দুবাবুর কাছে হাজির।
নবেন্দুবাবু চমকে উঠলেন, আপনি! হ্যাঁ আমি। তুমি একলা থাক বলে মাঝে মাঝেই সন্ধের পর আসি, কিন্তু কোনো দিনই দেখা পাইনি।
আপনি আমার এখানে এসেছিলেন?
প্রমোদবাবু একটু হেসে হাতের ছড়িটাকে পাশে রেখে বললেন, এসেছিলেন মানে? বেশ কয়েকদিন এসেছি।
নবেন্দুবাবু অত্যন্ত লজ্জিতবোধ করেন। বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, কিন্তু আমি তো জানতাম না, তাই…
প্রমোদবাবু আবার হাসেন। বলেন, তোমার মতো ব্যাচেলার হলে আমিও থাকতাম না। যাকগে, ওসব কথা বাদ দাও। আজ দুপুরে আমার ওখানে চলে এসো। আচ্ছাও হবে, খাওয়া-দাওয়াও হবে।
কিন্তু…
ওসব কিন্তু-টিন্তু বললে চলবে না। তোমাকে আসতেই হবে।
.
নবেন্দুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, প্রমোদবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখি, আমার শ্বশুর, শাশুড়ি ও শিখারাণী তার জারজ সন্তান নিয়ে হাজির।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। আমি জানতাম না প্রমোদবাবু ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
আমি অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করি, তারপর কি হল?
স্বামী পরিত্যক্তা স্ত্রীর মুখে যে দুঃখ বেদনা থাকে, তার চিহ্নমাত্রও শিখারাণীর মুখে দেখলাম না!
বলেন কি?
হ্যাঁ কবিতা ঠিকই বলছি। রাগে, দুঃখে ঘৃণায় আমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রমোদবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং সেই রাত্রেই কাশী ছেড়ে সোজা হরিদ্বার চলে গেলাম।
প্রশ্ন করলাম, আপনার বাবা-মার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না?
চিঠিপত্র লিখতাম না, কিন্তু প্রত্যেক মাসে মাকে টাকা পাঠাতাম।
আচ্ছা, তারপর বলুন।
নবেন্দুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললেন, হরিদ্বারে গিয়ে অঘটন ঘটে গেল।
ওর হাসি দেখে আমারও হাসি পায়। বলি, কী আবার অঘটন ঘটল?
আবার কোনো প্রমোদবাবুর সঙ্গে যাতে দেখা না হয়, এই ভেবে আমি গুজরাতিদের একটা ধর্মশালায় উঠেছিলাম। আসার সময় ট্রেনে ঘুম হয়নি বলে প্রথম দিন ঘুমিয়েই কাটালাম। তারপর থেকে দু-এক ঘণ্টা ব্ৰহ্মকুণ্ডে ঘোরাঘুরি ছাড়া বাকি সব সময় ধর্মশালায় নিজের ঘরেই থাকতাম।
সারাদিন ঘরে বসে কী করতেন?
আমার ঝোলার মধ্যে সঞ্চয়িতা ছিল। সারাদিন আপন মনে কবিতা পড়তাম। কখনও জোরে জোরে, কখনও মনে মনে।
তারপর?
দু-একদিন পরে দুপুরের পর হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা পাঁচ-ছ বছরের একটি ছেলের হাত ধরে নবেন্দুবাবুর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন?
ভদ্রমহিলা পরিষ্কার বাংলায় বললেন, না এমনিই এলাম।
নবেন্দুবাবু ওর হাতে শাখা, সিঁথিতে সিঁদুর না দেখে ভেবেছিলেন উনি গুজরাতি। তাছাড়া পরনে সাদা শাড়ি। তাই একটু অবাক হয়েই বললেন, আপনি বাঙালি?
হ্যাঁ।
নবেন্দুবাবু বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন। তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ছেলেটি তো ভারি সুন্দর।
ও আমার ভাইপো।
ও! এবার নবেন্দুবাবু শতরঞ্চিটা বিছিয়ে দিয়ে বললেন, বসুন।
ওরা শতরঞ্চিতে বসতেই নবেন্দুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা বুঝি দল বেঁধে বেরিয়েছেন?
না, দাদা-বৌদির সঙ্গে এসেছি।
দাদা বৌদিকেও ডাক দিন।
ওরা আজ হৃষিকেশ গেলেন। কাল ওখান থেকে কেদার বদ্রী রওনা হবেন।
আপনি গেলেন না?
ভদ্রমহিলা একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, বিধবা বোনকে হরিদ্বার পর্যন্ত এনেছে, আর কত ঘোরাবে?