কী ভেবেছিলেন?
সে আর শুনতে চেয়ো না। তোমাকে এয়ারপোর্টে দেখেই আমার রক্ত টগবগ করতে শুরু করে। তারপর সারাটা দিন অনেক কিছু ভেবেছি।
আমি হাসি। জিজ্ঞাসা করি, তারপর?
বদ মতলব মাথায় নিয়েই কাল সন্ধেবেলায় তোমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার সংযম দেখে বুঝলাম, তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার হবে না।
ওর কথা শুনে আমি একটু জোরেই হাসি।
না, না, কবিতা, হাসির কথা নয়। যে মেয়ে ওয়াইন খেয়ে ওই রকম অশ্লীল ও উত্তেজনা পূর্ণ নাচ দেখতে দেখতেও নিজেকে সংযত রাখতে পারে, তাকে এদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে নিয়ে বদমাইসি করা যায় না।
বললাম, আমাকে শ্রদ্ধা করারও দরকার নেই, ভালোবাসাও দরকার নেই।
এবার নবেন্দুবাবু একটু হেসে বললেন, ওটা আমার মনের ব্যাপার। তারপর উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যাই হোক, তোমাকে অনেক কিছু বলব।…
কী দরকার?
হাজার হোক তুমি একলা থাকো। তোমার জানা দরকার, তোমার আশেপাশে আমার মতো হিংস্র নেকড়েও ঘোরাঘুরি করছে।
সত্যি রিপোর্টার, নবেন্দুবাবু আমার এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। যে কালো মেয়েটির দুটি বড় বড় ঘন কালো চোখের আলোয় তুমি অন্ধকার পথ দেখতে পেয়েছ, সে আর তুমি আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।
২০. নবেন্দুবাবু প্যারিস থেকে প্রায়
নবেন্দুবাবু প্যারিস থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে থাকলেও প্রায় প্রত্যেক শুক্রবার বিকেলে এসে হাজির হতেন; তবে হ্যাঁ, আমার ওখানে উঠতেন না। আমার অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই একটা ছোট হোটেলে উঠতেন। আমরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, গল্পগুজব, ঘোরাঘুরি করতাম। বেশ কেটে যেত সপ্তাহের শেষ দুটো দিন।
মাস দুই এইভাবে চলার পর সত্যি আমরা দুজনে বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম। প্রথম প্রথম বিদেশে আসার পর পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভয় করত, দ্বিধা হতো। আস্তে আস্তে এই ভয় বা দ্বিধ সংকোচ কেটে গেল। তাই তো নবেন্দুবাবুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে খুব বেশি সময় লাগল না।
কফি খেতে খেতে আমি বললাম, সারাদিনই তো আমার এখানে কাটান। রাত্তিরের কটা ঘণ্টা কাটাবার জন্য এতগুলো ফাঙ্ক নষ্ট করে হোটেলে থাকার কী দরকার?
নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, শুধু তোমার জন্যই তো হোটেলে থাকি।
আমার জন্য আপনি হোটেলে থাকেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার জন্য।
আমার জন্য আপনি কেন হোটেলে থাকবেন?
সত্যি বলছি কবিতা, তোমার জন্যই হোটেলে থাকি। দিনেরবেলা তবু কোনোমতে নিজেকে সংযত রাখতে পারি। সন্ধের পর কয়েক পেগ হুইস্কি বা দু-এক বোতল ওয়াইন পেটে পড়ার পর তোমাকে দেখে যে আমার কি মনে হয়…
অত ভূমিকা না করে আসল কথা বলুন।
এবার উনি হেসে বললেন, আমার মতো দস্যু রাত্তিরে তোমার এই অ্যাপার্টমেন্টে থাকলে কত কী সম্পদ যে লুঠ করবে, ত র কী ঠিকঠিকানা আছে?
আমিও হেসে বলি, কোনো স্যুই এত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কিছু ক্ষতি করতে পারে না।
কথাটা সত্যি হলেই ভালো।
আরো কিছুদিন এইভাবে মেলামেশা করার পর মনে হল নবেন্দুবাবু চরিত্রহীন হলেও মানুষ হিসেবে ভালোই। তাছাড়া মনে হল, এত বিদ্যা-বুদ্ধি সাফল্যের মধ্যেও ওর মনে অনেক ব্যথা-বেদনা লুকিয়ে আছে।
.
ভাই রিপোর্টার, দুনিয়ার সবাই জানে মদ্যপানের অনেক দোষ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে মদ্যপান মানুষকে সত্যবাদী করে। মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যে কথা কোনোদিন কাউকে বলতে পারবে না, মদ্যপানের পর সেই মানুষই তার সব গোপন কথা মুক্তকণ্ঠে বলতে পারে। একদিন মদ্যপানের পর নবেন্দুবাবুও আমাকে অনেক দুঃখের কথা বললেন।
একে গরিব স্কুল মাস্টারের ছেলে, তার ওপর নটি ভাইবোন। এ ছাড়াও এক বিধবা পিসিমা ও তার কন্যা। অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যেই নবেন্দু স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হলেন। প্রথম বার্ষিকী পরীক্ষার খাতা দেখেই অধ্যক্ষ ঊষানাথ বসু চমকে উঠলেন। কয়েকদিন পরে ক্লাসে এসে নবেন্দুর খোঁজ করতেই টের পেলেন, দীর্ঘদিন মাইনে না দেবার জন্য ওর নাম রেজিস্টারে নেই।
অন্ধকার রাত্রির পরই সূর্যোদয়। অধ্যক্ষ উষানাথ বসুর কৃপায় নবেন্দু সসম্মানে অনা- নিয়ে বি.এ. পাশ করে এম. এ পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।
নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, এম. এ পড়ার সময় পেয়ে গেলাম ডক্টর সরকারকে। উনি না থাকলে আমার এম. এ. পাশ করা হতো না। বাড়িতে থাকলে লেখাপড়া করতে অসুবিধে হবে বলে পরীক্ষার আগের তিন মাস উনি আমাকে ওঁর বাড়িতেই রেখে দিলেন।
সত্যি, ডক্টর সরকারের মতো মানুষ হয় না।
সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওঁর সংগ্রহ করা মেটিরিয়ালস আর নোক্স নিয়েই আমি আমার প্রথম বই লিখি। নবেন্দুবাবু একটু স্নান হাসি হেসে বললেন, আমি জীবনে আর কোনো অধ্যাপক দেখিনি যিনি ছাত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য এমন ভাবে স্বার্থত্যাগ করবেন।
তারপর?
পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছিল বলে অধ্যক্ষ ঊষানাথ বসু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একশো। পঁচিশ টাকার লেকচারার করে দিলেন গিরিডির এক কলেজে।
নবেন্দুবাবু গেলাসে শেষ চুমুক দিতেই আমি আবার গেলাস ভরে দিলাম।
এ কী? আবার দিলে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তারপর কী হল বলুন।
নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, অধ্যক্ষ মহাশয় লুকিয়ে আমার গরিব বাবাকে কিছু অর্থ দিয়ে। আমাকে কিনে নিলেন।…