তোমার অসুবিধে না হলে আমারও হবে না।
আমি আগের দিন রাত্রেই সবকিছু রান্না করে রেখেছিলাম। তাই নবেন্দুবাবু বাথরুমে যেতেই আমি ভাত বসিয়ে দিলাম। অন্যান্য খাবার-দাবার গরম করতে না করতেই উনিও তৈরি হয়ে গেলেন।
খেতে বসে নবেন্দুবাবু বললেন, এত রান্না করেছ কেন?
রান্না করতে আমার ভালো লাগে। তাছাড়া শনি-রবিবারেই শুধু একটু বেশি রান্না করি। অন্যদিন তো যাহোক কিছু খেয়ে নিই।
উনি হেসে বলেন, তুমি রান্না করতে ভালোবাস আর আমি খেতে ভালোবাসি।
আমি জানি।
স্যার সে কথাও তোমাকে জানিয়েছেন?
আমরা দুজনেই হাসি।
খেয়ে নবেন্দুবাবু সত্যি তৃপ্তিলাভ করলেন। আমার রান্না খেয়ে তন্ময়ও এমনি তৃপ্তিলাভ করত। খাওয়া-দাওয়া শেষে উনি বললেন, ওবেলায় রান্না করো না।…
কেন?
প্যারিসে এসেও শনিবার সন্ধ্যা বাড়ির মধ্যে কাটাব?
না, সেদিন সন্ধ্যায় নবেন্দুবাবু আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী রইলেন না। বেরিয়ে পড়লেন। একলা নয়, আমাকে সঙ্গে নিয়েই বেরুলেন।
যেসব ভারতীয়রা নিজের স্ত্রীর হাত ধরে রাস্তায় চলাফেরা করতেও অভ্যস্ত নয়, যারা বেশি চা খাওয়া পর্যন্ত পছন্দ করেন না, তারাই প্যারিসে এসে বোতল বোতল শেরি-স্যাম্পেন বা ওয়াইন খান আর বিবস্ত্রা সুন্দরী যুবতীর নাচ দেখেন।
কলকাতার বিখ্যাত অধ্যাপক নবেন্দুবাবুও ব্যতিক্রম হলেন না। নাচ দেখতে দেখতে উনি আমাকে বললেন, যাই বল কবিতা, এরা প্রাণ খুলে আনন্দ করতে জানে। আর এরা প্রাণভরে আনন্দ করে বলেই প্রাণভরে কাজও করে।
আমি বললাম, বোধহয় প্রাণভরে কাজ করে বলেই এমন আনন্দ করতে পারে।
আরো এক বোতল ওয়াইন পেটে যাবার পর নবেন্দুবাবু হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কবিতা, আমরা খুব কাজও করব, খুব আনন্দও করব।
আমি বুঝলাম, উনি স্বাভাবিক নেই। তাই হেসে বললাম, নিশ্চয়ই আপনি কাজও করবেন, আনন্দও করবেন।
প্যারিসে এসে প্রথম সন্ধ্যা ওর ভালোই কাটল। নাচ-গান খানা-পিনা সেরে আমরা যখন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম, তখন রাত প্রায় দুটো।
অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকতেই উনি আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টান দিয়ে বললেন, কবিতা, তুমি বড় ভালো মেয়ে।
আমি হেসে বললাম, ধন্যবাদ। ওর হাতে টান দিয়ে বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি শোবার ব্যবস্থা করি।
এই সন্ধেবেলায় শোবে?
এখন অনেক রাত হয়েছে।
সো হোয়াট? হ্যাভ ইউ গট এনি ড্রিক?
নো।
প্যারিসে থাকো আর বাড়িতে একটা বোতল রাখ না?
না। এবার আমি একটু জোর করেই ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম। বললাম, আপনি অনেক ড্রিঙ্ক করেছেন। এবার আপনি জামাকাপড় পাল্টে শুয়ে পড়বেন।
নো ডার্লিং! আই মাস্ট নট শিপ টু নাইট।
তাহলে আপনি এ ঘরে বসে থাকুন; আমি ঘরে শুতে যাচ্ছি।
ঠিক আছে, চল, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।
আমার এমনিই ঘুম আসবে। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
তোমার মতো সুন্দরীকে ঘুম পাড়াতে আবার কষ্ট হয় নাকি? বরং…
আঃ! কী যা তা বলছেন?
আই অ্যাম সরি কবিতা।
যাই হোক প্রায় জোর করেই ওকে শুইয়ে দিলাম। মাঝখানের দরজা লক করে আমিও শুয়ে পড়লাম। তখন প্রায় তিনটে বাজে।
পরের দিন ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। ও ঘরে নবেন্দুবাবু তখনো ঘুমোচ্ছেন। আমি বাথরুম থেকে ঘুরে এসে চা খেলাম। কাপড়-চোপড় বদলেই কিছু কেনাকাটার জন্য দরজা লক করে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু সজি আর চিকেন কিনে ফিরে এসে দেখি, নবেন্দুবাবু ড্রইংরুমে বসে আছেন।
আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সংসারের কাজকর্ম আরম্ভ করে দিয়েছ?
একটু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম।
চা খাওয়াবে?
নিশ্চয়ই।
চা খেতে খেতেই নবেন্দুবাবু বললেন, কবিতা তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, কী অপরাধ করেছেন যে ক্ষমা চাইছেন?
কাল রাত্রে নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করিনি।
আমি হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে জানলেন আপনি খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করেননি?
আমার লেখাপড়া-বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় বাইরের লোকজন জানতে পারে কিন্তু আমার আসল স্বভাব চরিত্রের খবর শুধু আমিই জানি।
এ কথা তো সবার বেলায় প্রযোজ্য।
তা ঠিক কিন্তু সবার স্বভাব-চরিত্রের তো তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য খবর থাকে না-আমার আছে।
আমি আর প্রশ্ন করি না। চুপ করে থাকি। চা খাই। নবেন্দুবাবু বলেন, আমি বিশেষ ড্রিঙ্ক করি না। কাল ড্রিঙ্ক করলাম প্রায় বছর খানেক বাদে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
এবার একটু হেসে বললেন, গত বছর সিমলা ইনস্টিটিউট অব হায়ার স্ট্যাডিজে গিয়েছিলাম দেড় মাসের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার এক অল্পবয়স্কা অধ্যাপিকাও তখন ওখানে এসেছিলেন। কদিনের ছুটিতে চাইল বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ আমার হোটেলেই ওর সঙ্গে দেখা…
আমি বললাম, ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে তখন ড্রিঙ্ক করেছিলেন বুঝি?
নবেন্দুবাবু বললেন, শুধু ড্রিঙ্ক করিনি, তিনটে রাতও ওরই সঙ্গে কাটাই।
আমি পট থেকে ওর কাপে চা ঢেলে দিই। উনি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, আমাদের দেশে বদমাইসি করার চাইতে বদমাইসি করার খবর ছড়িয়ে পড়াকে সবাই ভয় করে। আমিও করি। তাই আমিও এসব কথা কখনও কাউকে বলি না।
তাহলে আমাকে বলছেন কেন?
ঠিক কী কারণে বলছি, তা বলতে পারব না; তবে তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে।
কেন?
উনি একটু হেসে বললেন, ডক্টর সরকার আর অমিয়র কাছে তোমার এত প্রশংসা শুনেছি যে মনে মনে তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু ভেবেছিলাম।