পূজা আসছে। তাই নবেন্দুর সঙ্গে তোমার জন্য একটা শাড়ি পাঠাচ্ছি। এ ছাড়া চিড়ে-মুড়ি-বড়ি ইত্যাদি ধরনের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়াও দু-তিনটে পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা পাঠাব…
.
৭ই সেপ্টেম্বর সকালে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ওরলি এয়ারপোর্টে। ঠিক সময়েই প্লেন এলো। শাড়ি পরা আর কোনো মেয়ে ছিল না বলে আমাকে চিনতে নবেন্দুবাবুর একটুও কষ্ট হল না।…আই হোপ তুমিই কবিতা?
হেসে বললাম, হ্যাঁ।
তোমাকে অনেক কষ্ট করে আসতে হল।
না, না, কষ্ট কিছু না; বরং মাঝে মাঝে নিজের দেশের মানুষকে কাছে পেলে ভালোই লাগে।
তা ঠিক কিন্তু…
ডক্টর সরকার যখন বলেছেন তখন দ্বিধা করার কোনো কারণ নেই।
যাই হোক মালপত্র পিছনের সীটে বোঝাই করে ওকে সামনের দিকের ডানদিকে বসালাম। গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ার, ফোর্থ গিয়ার। প্রায় একশো কিলোমিটার স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছি। হঠাৎ নবেন্দুবাবু বললেন, তুমি তো দারুণ জোরে গাড়ি চালাও।
হেসে বললাম, এখানে চালাতেই হয়।
তা ঠিক। তবে লেফট্-হ্যান্ড ড্রাইভ গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয় না?
আমি তো কলকাতায় গাড়ি চালাতাম না; তাই কোনো অসুবিধে হয় না।
তুমি বোধহয় অনেক দিন দেশে যাও না…
হ্যাঁ, দেশ ছাড়ার পর আর যাইনি।
যেতে ইচ্ছে করে না?
ইচ্ছে করে ঠিকই কিন্তু ঠিক নিজের কেউ নেই বলে আর এত খরচ করে যেতে মন চায় না।
ছুটিতে কোথাও যাও না?
গতবার এথেন্সে গিয়েছিলাম। এবার কোথায় যাব ঠিক করিনি।
কবে ছুটি পাবে?
ফার্স্ট অক্টোবর থেকেই আমার ছুটি।
আমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেই নবেন্দুবাবু বললেন, অপূর্ব সাজিয়েছ তো।
আমি একটু হেসে বললাম, স্বামী-পুত্রের ঝামেলা তো নেই। তাই অফিস থেকে ফিরে এসে ঘর গুছিয়েই সময় কাটিয়ে দিই।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে কফি করতে গেলাম। কফি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই নবেন্দুবাবু দুটো প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ডক্টর সরকার পাঠিয়েছেন বুঝি?
একটা উনি পাঠিয়েছেন, অন্যটা অমিয়।
খুলে দেখি, ওরা দুজনেই দুটি সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাঠিয়েছেন। এছাড়াও আরো অনেক কিছু। এবার উনি দুতিনটে শারদীয় সংখ্যা এগিয়ে দিতেই বললাম, এগুলো দেখলেই কলকাতার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
সত্যি, এই শারদীয় সংখ্যা নিয়ে সারা বাংলাদেশে যে চাঞ্চল্য দেখা যায়, তেমন আর কোথাও হয় না।
কফি খেতে খেতেই বলি, বিদেশে এসে অনেক কিছু পেযেছি, কিন্তু কলকাতা ছাড়ার জন্য অনেক কিছু হারাতেও হয়েছে।
এবার উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আর কত কাল বিদেশে থাকবে?
আমার কাছে দেশ-বিদেশ দুইই সমান।
ও কথা বোলো না কবিতা। হাজার হোক নিজের দেশ, নিজের পরিবেশ, নিজের ভাষা, বন্ধুবান্ধবের আকর্ষণ তো আলাদা।
তা ঠিক কিন্তু ওখানে আমার মতো মেয়ের পক্ষে একলা থাকা খুবই কঠিন।
যদি কলকাতায় থাকতে না চাও তাহলে দিল্লি বা বোম্বতে থাকো।
এবার একটু হেসে বললাম, দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়?
নবেন্দুবাবুকে দেখেই বোঝা যায়, উনি বোদ্ধা। চোখে-মুখে একটা ঔজ্জ্বল্য। বয়স পঞ্চাশের ঘরে হলেও সারা চেহারায় যৌবনের দীপ্তি। কথাবার্তায় অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন। মনে মনে বললাম, ডক্টর সরকার ঠিকই লিখেছেন।
কফি খাওয়া শেষ হলে উনি সুটকেশ থেকে একটা শাড়ি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, দিস ইজ-এ টোকন প্রেজেনটেশন ফ্রম ইওর নিউ ফ্রেন্ড!
অত্যন্ত দামি কাঞ্চিপুরম সিল্কের শাড়ি দেখেই বললাম, এত দামি শাড়ি আনার কি দরকার ছিল?
নবেন্দুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, তুমি পরলে কোনো শাড়িকেই দামি মনে হবে না। তোমার রূপ-গুণের কাছে আর সবকিছু ম্রিয়মান হয়ে যায়।
কথাটা শুনেই একটু বেসুরো মনে হল কিন্তু উনি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ডক্টর সরকার যাকে মা বলেন সে তো সাধারণ মেয়ে হতে পারে না।
হেসে বললাম, সত্যি আমি অসাধারণ?
নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট!
আমার আগের অ্যাপার্টমেন্টের চাইতে এটা একটু বড় হলেও শোবার ঘর একটাই। এই ঘরেই তমার সবকিছু। অন্য ঘরের একদিকে ছোট্ট একটা খাবার টেবিল। টেবিলের দুদিকে দুটো চেয়ার। অন্যদিকে বসার ব্যবস্থা। ছোট্ট একটা পান্ট্রি। ছোট্ট একটা বাথ-কাম-টয়লেট। কোনোমতে স্নানাদি সারা যায় কিন্তু কোনোমতেই কাপড়-চোপড় বদলানো যায় না। তাছাড়া বাথরুম হচ্ছে প্যান্ট্রির পাশে। কাপড়-চোপড় পরার জন্য আমাকে ড্রইংরুম পার হয়ে শোবার ঘরে যেতে হয়। একলা থাকি বলে এই ব্যবস্থায় কোনো অসুবিধে হয় না। আজ নবেন্দুবাবু আসায় একটু মুশকিলই হল।
আমি বললাম, আমার অ্যাপার্টমেন্ট নেহাতই ছোট। চটপট কিছু করা মুশকিল। নই এবার উঠুন।
নবেন্দুবাবু বললেন, অ্যাপার্টমেন্ট ছোট হলেও সবকিছুই তো আছে।
এবার আমি হাসতে হাসতে বললাম, আছে সবকিছুই; তবে আমি বাথরুম গেলে আপনাকে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
উনি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, তার মানে?
বাথরুম খুবই ছোট। তাই এই ঘর হয়ে শোবার ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পরতে হয়।
সর্বাঙ্গ আবরণকারী কিছু ব্যবহার কর না?
অ্যাপার্টমেণ্টের মধ্যে ওই তো একমাত্র পোশাক। তাশলে আর চিন্তার কি?
না না, চিন্তার কিছু নেই, কিন্তু চটপট কাজ করতে আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে।