সেদিন কাকুর সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ তর্ক করেছিলাম কিন্তু এতদিন পরে আজ আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে, কাকু ঠিকই বলেছিলেন।
কাকু আমার বাবার বন্ধু হলেও বয়স ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতে কোনো সংশয় হয়নি। তারপর ওর ফ্ল্যাটে থাকার সময় আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। আমার সঙ্গে ওর দৈহিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কাকুকে কোনোদিনই চরিত্রহীন মনে করিনি। রমলাকে দেখার পরই মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলাম। হঠাৎ একটা ঘটনাবহুল অধ্যায়ের যবনিকা টেনে আমি সুপর্ণার কাছে চলে গেলাম।
কাকুর কথা, আমার পুরনো দিনের কথা আজকাল আমি মনে করি না। বোধহয় মনে করতে চাই না। প্রয়োজনও অনুভব করি না। তোমাকে চিঠি লিখতে গিয়ে আমার পুরনো দিনের অনেক কথাই নতুন করে মনে পড়ছে। আজ তোমার কাছে স্বীকার করছি, ইদানীং কালে মাঝে মাঝেই আমার কাকুর কথা মনে হয়। জানি না তিনি কোথায়। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না। বেঁচে থাকলেও হয়তো সুস্থ নেই। হয়তো সালাউদ্দিন কাকুর ওখানে কাজ করছে না। তার কোনো খবরই জানি না। তাই তো হাজার রকমের খারাপ চিন্তা মনের মধ্যে ভীড় করে। কাকু ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছেন কী? উনি অর্থনৈতিক কষ্ট পাচ্ছেন না তো?
যে মানুষটাকে একদিন অসহ্য মনে হয়েছিল, যাকে অসম্ভব ঘৃণা করেছি, এখন মাঝে মাঝে সারারাত তারই কথা ভাবি। না ভেবে পারি না। মাঝে মাঝেই ওকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। এখন বোধহয় কাকুকে আর ঘৃণা করি না।
বলতে পারো ভাই, কেন এমন হয়? তাই তো বলছি, যারাই আমার কাছে এসেছেন, তারাই আমার কাছ থেকে কিছু নিয়েছেন, কিছু দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে অমিয়র মতো পুরুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য না করলেও এই সংসারের চোদ্দ আনা মানুষই ব্যবসাদার। সবাই লেনদেন চায়।
অমিয় স্বতন্ত্র নয়, অনন্য, অসাধারণ। ওদের কথা আলাদা। অমিয়কে শুধু ভালোবাসিনি, শ্রদ্ধাও করি। ইউনেস্কোর আজিজুল ইসলাম ওই ধরনের।
ইন্ডিয়ান এম্বাসির কালচারাল কাউন্সিলার মিঃ গিদওয়ানীর বাড়ির এক পার্টিতে আমার সঙ্গে আজিজুলের প্রথম আলাপ। সেইদিনই বুঝেছিলাম, এই ঢাকাই বাঙালি সত্যি অনন্য। আর দশজনের মধ্যেও ওকে চিনতে কষ্ট হয় না।
গিদওয়ানী আমাদের আলাপ করিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ও আমাকে বলল, আপা, তুমি আমাকে আজিজ বলেই ডাকবে।
আপা মানে?
দিদি! দিদি! আজিজ হেসে বলল, জানো আপা, ইউরোপ আমেরিকা অনেকদিক থেকে এগিয়ে আছে কিন্তু হালাগো সমাজে আপাও নাই, ভাবীও নাই।
আমি বলি, ঠিক বলেছ।
আজিজ এবার একটু গম্ভীর হয়েই বলে, হতভাগারা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে বড্ড বেশি নাচানাচি করে কিন্তু দিদি বা বৌদির চাইতে ভালো গার্ল ফ্রেন্ড কী হতে পারে?
আমি চুপ করে থাকি।
ও আবার বলে, এ ছাড়া শালী বা দেওর যে কী অদ্ভুত জিনিস তাও শালারা বুঝল না।
আমার মতো আজিজও একটা ইউনেস্কো প্রজেক্ট কাজ করত। বছর দুই শুধু আজিজ ছাড়া আর কোনো পুরুষকে আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসতে দিইনি।
তন্ময়ের জন্য সমস্ত পুরুষকেই আমি ঘেন্না করতে শুরু করেছিলাম কিন্তু আজিজকে পেয়ে বুঝলাম, না, এই পৃথিবীর সব পুরুষই কামনা-বাসনার আগুনে জ্বলে না।
আজ আর লিখছি না। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। দু-চারদিন পরেই আবার চিঠি দিচ্ছি। তোমাদের। দুজনের চিঠি আজই পেলাম।
১৯. আজিজুল প্যারিস ছেড়ে যাবার
আজিজুল প্যারিস ছেড়ে যাবার মাস দেড়েক পরে হঠাৎ অফিস থেকে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেই ডক্টর সরকারের চিঠি পেলাম।…
.
মা, আমি তোমার নেহাতই অপদার্থ সন্তান। তাই তো আজকাল তোমাকে বিশেষ চিঠিপত্রই লিখি না। তোমার চিঠি যে খুব নিয়মিত পাই, তা নয় কিন্তু তবুও তুমি সময় পেলেই আমাকে চিঠি লেখ। তাছাড়া কিছুদিন আগে আজিজুল নামে একটি ছেলে তোমার পাঠানো দুটি শার্ট, দুটি টাই আর কয়েক প্যাকেট ব্লেড দিয়ে গেল। ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝলাম, ও তোমার বিশেষ গুণগ্রাহী ও ভক্ত। ভেবেছিলাম, জিনিসগুলো পাবার প্রাপ্তি সংবাদ পাঠাবে, কিন্তু তা আর হল না। সপ্তাহখানেকের জ্বরে শরীর এমন কাহিল হল যে বহুদিন কোনো কাজকর্মই করিনি। অমিয় আর সুপর্ণা মাঝে মাঝেই আমাকে দেখতে আসে। মনে হয় জিনিসগুলির প্রাপ্তি সংবাদ ওদের চিঠিতেই জেনেছ।
এবার একটু কাজের কথায় আসি। আমার অধ্যাপনা জীবনের প্রথম ব্যাচের ছাত্র নবেন্দু এখন শিক্ষাজগতের একটি ধ্রুবতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ামণি। তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি স্বদেশে এবং বিদেশে। কতবার যে বিদেশ গেছে, তার ঠিকঠিকানা নেই। যাতায়াতের পথে প্যারিসে থেকেছে দু-একদিন কিন্তু এর বেশি নয়। এবার নবেন্দুকে প্যারিসেই থাকতে হবে তিন মাস। ওখানকার কর্তৃপক্ষই ওর সব ব্যবস্থা করবেন। তোমাকে দুটি অনুরোধ। আমার পরামর্শ মতো। নবেন্দু শনিবার (৭ই সেপ্টেম্বর) সকাল দশটায় এয়ার ফ্রান্স-এর ফ্লাইটে ওরলি এয়ারপোর্টে পৌঁছবে। সেদিন তো তোমার ছুটি। তাই তুমি যদি এয়ারপোর্ট থেকে ওকে তোমার ওখানে একদিনের জন্য নিয়ে যাও, তাহলে খুব ভালো হয়। রবিবার বিকেলের দিকে ওর নির্দিষ্ট আস্তানায় চলে যেতে একটু সাহায্য করবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, নবেন্দু ভোজনরসিক এবং আমাদের নিজস্ব খাবার ছাড়া অন্য কোনো দেশের কোনো খাবার খেয়েই নাকি ওর পেট ভরে না। তাই শনিবার-রবিবার তোমার অন্য কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে ওকে মাঝে মাঝে তোমার ওখানে আসতে বল। নবেন্দু মহাপণ্ডিত লোক। মনে হয় ওর সান্নিধ্যে তোমার ভালোই লাগবে।…