তন্ময় মুখ নীচু করে বলল, আমাকে বিয়ে করলে তো তুমি কোনদিনই সন্তানের মা হতে পারবে না।
আমি উন্মাদের মতো চিৎকার করে বললাম, তাই বুঝি কলকাতায় বিয়ে করা বৌ রেখে এসে লন্ডনে শিখাকে নিয়ে ফুর্তি করতে?…শিখাকে মাতাল করে তার নেকেড ছবি তুলেছ কেন? ওকে ব্ল্যাক মেলিং করবে?
তন্ময় চুপ।
আমাকে উলঙ্গ করে আমার ছবি তুলবে না? কাম অন! হ্যাভ মাই নেকেড ফটোগ্রাফ!
তন্ময় তখনো চুপ।
আমি এক লাথি মেরে হুইস্কির বোতলটা ফেলে দিয়ে বললাম, এনাফ ইজ এনাফ! নাউ গেট আউট মাই বয়। বেরিয়ে যাও; এখুনি বেরিয়ে যাও।
সত্যি বলছি ভাই, সেদিন তন্ময়কে তাড়িয়ে দেবার পর আর কোনোদিন ওর কথা আমি মনেও করিনি।
১৮. ইউনেস্কোতে বছর তিনেক
বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রীয় সংস্থা ইউনেস্কোতে বছর তিনেক ছিলাম। নানা কাজে সারা পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী ও মনীষীদের সমাগম হয় ইউনেস্কো হেড কোয়াটার্সে। কখনও কাজে, কখনও ককটেল-ডিনার রিসেপশনে তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার দেখা হতো। আলাপ হতো। কখনও কখনও এদের সঙ্গে ঘুরতে হতো বিভিন্ন দেশে।
ওই তিন বছরে এমন অনেককে কাছে পেয়েছি যাদেব সান্নিধ্যলাভে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। এদের কাছে কত কথা শুনেছি, কত কথা জেনেছি। আমি বিস্মিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি এদের পাণ্ডিত্য ও মহানুভবতা দেখে।
তন্ময় আমাকে অনেক দুঃখ, ব্যথা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মনে মনে আমি ওর প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ? কারণ ওরই আগ্রহে ও প্রচেষ্টায় আমি ডক্টর রবার্ট কিং-এর সামধ্যে আসি এবং আমার জীবনে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা হয়। আজ যে আমি ইউনাইটেড নেশনস্ এ আছি, তার পিছনেও তো ওদেরই অবদান।
একদিন রাগ করেই কাকুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সুপর্ণা-অমিয়র আস্তানায় উঠি। কিন্তু আজ যখন নিজের অতীতের কথা ভাবি, ভালো মন্দের হিসাব দেখতে বসি, তখন মনে হয়, আমার জীবনে ওই চরিত্রহীন কাকুর অবদানও কম নয়। হাজার হোক, পিতৃ-মাতৃহীন তোমার এই দিদি তারই স্নেহচ্ছায়ায় উচ্চ শিক্ষালাভ করে। আমি লেখাপড়ায় নেহতি খারাপ ছিলাম না কিন্তু পড়াশুনার জন্য খুব বেশি পরিশ্রম করতে একটুও ভালো লাগত না। বিশেষ করে বাবা-মাকে হারাবার পর এমন একটা সময় এসেছিল যখন আমি সত্যি সত্যি লেখাপড়া ছেড়ে দেবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু না, তা হয়নি; হতে পারেনি শুধু ওই মানুষটার জন্য। যখন রিসার্চ করছি, তখন মাঝে মাঝেই মনে হতো, কী হবে রিসার্চ করে? ডক্টরেট হব? অধ্যাপনা করব? না, না, পোষা ময়না পাখির মতো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর একই কথা ছাত্রছাত্রীদের বলতে পারব না।…
পর পর তিন-চারদিন শুধু গল্প-উপন্যাস পড়ছিলাম আর বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখছিলাম। প্রথম কদিন কাকু কিচ্ছু বললেন না। তারপর একদিন ইভনিং শোতে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরতেই কাকু হাসতে হাসতে বললেন, আই ফিল হ্যাপি টু সী ইউ এনজয়িং।
আমি একটু হেসে বললাম, থ্যাঙ্কস।
মাঝে মাঝে এই রকম আনন্দ করা খুব ভালো।
আমি তো ভাবছি এইভাবে আনন্দ করেই জীবনটা কাটিয়ে দেব।
শুধু আনন্দ করেই কাটিয়ে দেবে?
হ্যাঁ।
পারবে?
না পারার কি আছে?
কাকু মাথা নেড়ে বললেন, না কবিতা, পারবে না। কোনো মানুষই শুধু আনন্দ করে জীবন কাটাতে পারে না। কম-বেশি কিছু কাজ কর্ম দায়িত্ব পালন না করে মানুষ বাঁচতে পারে না। তুমিও পারবে না।
আমি তর্ক না করে চুপ করে রইলাম।
পরে, রাত্রে শোবার পর কাকু বললেন, সবাই লেখাপড়া করে না। সম্ভবও না। তোমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে কেউ কিছু বলতে পারত না, কিন্তু এখন তুমি লেখাপড়া বন্ধ করালে সবাই আমাকে দোষারোপ করবে। সবাই মনে করবে, লেখাপড়ার ব্যাপারে আমার কোনো উৎসাহ নেই বলেই তোমার লেখাপড়া হল না।
তাই কী?
হা কবিতা, সবাই তাই ভাববে। তাছাড়া তুমি লেখাপড়া না করলে আমি নিজেও মনে মনে অপরাধী হয়ে রইব।
আমি চুপ করে থাকি।
কাকু আবার বলেন, তুমি এম. এ. পাশ করলে, ডক্টরেট হলে আমিও সবাইকে গর্ব করে বলতে পারতাম…।
বিশ্বাস কর ভাই, কাকু কত রাত্রি না ঘুমিয়েও আমার নোটস টুকে দিয়েছেন। রিসার্চ করার সময় যে বই আমি কোথাও খুঁজে পেতাম না, সে বই কাকুই জোগাড় করে এনে দিতেন। শুধু কী তাই? কাকু নিজে টাইপরাইটারে টাইপ করে দিয়েছিলেন আমার থিসিস। অত্যন্ত পরিশ্রমের ও একঘেয়ে কাজ। আমি বার বার বারণ করেছিলাম কিন্তু না, উনি কিছুতেই শুনলেন
দুহাত দিয়ে হুইস্কীর গেলাসটা ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে কাকু বললেন, আমি জানি কবিতা, তুমি কিছু টাকা খরচ করলেই থিসিসটা ছাপিয়ে দিতে পারে কিন্তু তোমার থিসিস আমি নিজে টাইপ করলে আমি যে আত্মতৃপ্তি পাব যে আনন্দ পাব…
কিন্তু কাকু বড্ড পরিশ্রমের কাজ।
হোক। এবার কাকু এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে আমার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলেন, একদিন হয়তো তুমি অনেক দূরে চলে যাবে। হয়তো আমার সঙ্গে তোমার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, কিন্তু আর কোনো কারণে না হোক, অন্তত এই থিসিস টাইপ করার জন্য।
তুমি আমাকে ভুলবে না।
সেদিন আমি কাকুর কথার প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, আপনি থিসিস টাইপ না করলেও আমি কোনোদিন আপনাকে ভুলব না।
কাকু একটু হেসে বললেন, ও কথা বোলো না কবিতা। অনেক প্রিয়জনকেই মানুষ ভুলে যায়। তুমি যে একদিন আমাকে ভুলে যাবে না এ কথা জোর করে বলা যায় না।