ওকে কফি খেতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বল, কী খাবে?
ও কফির পেয়ালায় প্রথম চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, আসতে আসতেই খাবার কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
নটা বাজে। তাই ভাবছিলাম রান্না সেরেই গল্পগুজব করব।
ও হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আজ শুক্রবার। কাল-পরশু ছুটি। আজকের এই সন্ধ্যায় কেউ বাড়িতে বসে থাকে?
তা জানি কিন্তু তুমি ক্লান্ত হয়ে এসেছ বলেই ভাবছিলাম আজ আর বেরুব না।
ও আমার কোনো কথা শুনল না। আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
শুধু তন্ময়কে দোষ দেব না। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমিও ভুলে গেলাম আমরা বাঙালি, ভা, তীয়। ভুলে গেলাম আমরা অবিবাহিত। আনন্দে উন্মত্ত হয়ে আমরা প্রায় নাচতে নাচতে ঘুরে বেড়ালাম। যত্র-তত্র-সর্বত্র। সাইড ওয়াক কাফেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এক বোতল ওয়াইন খেয়ে দুজনেই বেশ মদীর হয়ে উঠলাম। তারপর তন্ময় বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তারপর আরো ঘুরলাম, আরো ওয়াইন খেলাম। নাচ দেখলাম। তিন-চারটে কাফে থেকে কিছু কিছু খেয়ে ডিনারের পর্ব শেষ করলাম।
বোধহয় রাত দুটো-আড়াইটের সময় অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম। তারপরের কথা আর লিখব। শুধু জেনে রাখ, পরের দিন অনেক বেলায় যখন ঘুম ভাঙল, তখন চোখের সামনে দুটি উলঙ্গ নারী-পুরুষের পেন্টিং দেখে বিস্মিত হলাম। মিনিট খানেকের মধ্যেই আমার বিস্ময় কেটে গেল। বুঝলাম, ওটা কোনো শিল্পীর সৃষ্টি নয়; সামনের আয়নায় আমার আর তন্ময়ের প্রতিচ্ছবি।
আজ এখানেই শেষ করছি।
১৭. তন্ময় তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল
তন্ময় তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলাম। নানা কথা ভাবলাম। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তন্ময় আমাকে এমন করে জড়িয়ে ছিল যে আমি পাশ ফিরতে পারলাম না। তবু মুখ ঘুরিয়ে ওকে দেখলাম। দেখতে ইচ্ছা করল। ভেবেছিলাম, ওকে দেখেই রাগ হবে, ঘৃণা হবে কিন্তু রাগও হল না, ঘৃণা করতেও পারলাম না। আমার মায়া হল। তারপর হঠাৎ মনে হল, আমার একটা সন্তান হলে বেশ ভালো হতো। মনে হল, যে হয়তো এইভাবেই আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকত; হয়তো আমি পাশ ফেরবার চেষ্টা করলে ঘুমের ঘোরে ও আমাকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরত। মনে হল আরো কত কী! তারপর একবার ক্ষণিকের জন্য মনে হল, তন্ময় যদি হঠাৎ শিশু হয়ে যায় অথবা ঠিক ওর মতো একটা শিশু যদি আমার সন্তান হত, তাহলে বেশ হতো।
মাথার দিকের জানালা দিয়ে হঠাৎ এক ঝলক রোদ্দুর আমার মুখের ওপর পড়তেই আমার স্বপ্ন দেখা শেষ হল। তন্ময়ের ঘুম না ভাঙিয়ে অতি কষ্টে উঠে পড়লাম। দেখি, ঘরের মেঝের কার্পেটের ওপর আমাদের দুজনের জামা কাপড় ব্যাগ-পার্স ইত্যাদি চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। একটু হাসলাম। ভাবলাম, কাল রাত্রে কী দুজনেই একসঙ্গে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম?
তন্ময়ের গায়ে একটা চাঁদর দিয়ে আমি বাথরুমে গেলাম। আধঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে এসে দেখি ও তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। বুঝলাম, কাল রাত্তিরে একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করেছিল। তারপর অত রাত্তিরে ফিরে এসে আমাকে নিয়ে কতক্ষণ পাগলামি করেছে, তার ঠিক নেই। তাই ভাবলাম, ওকে ডাকব না।
আমি নিজের জন্য এক কাপ চা করেই রান্নাবান্নার উদ্যোগ শুরু করলাম। তারপর একটু হাত খালি হতেই ঘরদোর ঠিক করতে এলাম। তন্ময়ের জামা-কাপড় তুলতে গিয়েই দেখি পার্সের ভিতর থেকে কিছু কাগজপত্র বাইরে পড়ে রয়েছে। ওই কাগজপত্র তুলতে গিয়েই চমকে উঠলাম। তন্ময়ের ওপর রাগে-ঘেন্নায় আমার সারা মন প্রাণ বিদ্রোহ করে উঠল। একবার মনে হল, হাতের কাছে একটা চাবুক থাকলে আশা মিটিয়ে মারতাম। অথবা…
না, আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। একবার মনে হল, ঘরের দরজা লক করে। বেরিয়ে পড়ি। আবার মনে হল, না, না, আমি কেন পালাব। এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করলাম। তারপর চুপ করে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ পিছন থেকে এসে তনয় আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, সারারাত উপভোগ করেও মন ভরেনি?
তন্ময় আমার কাঁধের ওপর মুখ রেখে বলল, সারারাত কেন, সারা জীবন ধরে তোমাকে উপভোগ করলেও আশা মিটবে না।
সত্যি বলছ?
ও আমার বুকের ওপর একটা হাত রেখে বলল, সত্যি বলছি।
বুকের মধ্যে জ্বলে গেলেও জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি আমাকে খুব আদর করবে?
তন্ময় একটু হেসে বলল, এ কথা আবার জানতে চাইছ? বলেই ও আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েই চুমু খেল ওষ্ঠে, মুখে, গলায়। বারবার, বহুবার।
তোমাকে দেখে তো মনে হয়নি তুমি কোনো দিন এভাবে চাইতে পারো।
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, মানুষকে দেখে কতটুকু জানা যায়?
ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে তো নিশ্চয়ই জানা যায়।
জানি না।
জানি না বলছ কেন? আমি যেমন তোমাকে চিনেছি, জেনেছি, সেই রকম তুমিও তো আমাকে চিনেছ, জেনেছ।
আমি একটু হেসে বললাম, তোমরা বল, পুরুষস্য ভাগ্যম স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম মানুষ তো দূরের কথা, দেবতারাও জানেন না কিন্তু আমি যদি পারতাম তাহলে এই শ্লোকটা পালটে দিতাম।
কেন? বলতাম শুধু মেয়ে না পুরুষের চরিত্রও সত্যি অবোধ্য।