বেশ বৃষ্টি পড়ছিল। তাছাড়া অত্যন্ত ঠাণ্ডা পড়েছিল। বললাম, না, না, এই ঠাণ্ডায় বেরুব। তার চাইতে ঘরে বসে গল্প করে অনেক আনন্দ পাব।
গল্প করতে করতে আরো দু-একবার কফি খেলাম। তারপর তন্ময় বলল, কবিতা, চীজ পাকৌড়া ভাজো। আমি বরং একটা হুইস্কি কিনে আনি।
তারপর?
তারপর একটু খিচুড়ি। তারপর প্রস্থান।
কিন্তু না, সে রাত্রে তন্ময় যেতে পারল না। আমিই ওকে যেতে দিলাম না। ও যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল কিন্তু বাইরের দরজা খুলতেই আমি ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, না না তন্ময়, এই ওয়েদারে যেও না। মারা পড়বে।
বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। তার সঙ্গে দারুণ ঠাণ্ডা কনে বাতাস। তন্ময় বলল, এ ওয়েদারে আগে বেরুতে ভয় করত কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তারপর হেসে বলল, তাছাড়া পেটে গরম খিচুড়ি ছাড়াও দু-চার পেগ হুইস্কি পড়েছে।
না, না, আজ যেও না। কাল তো রবিবার। তাছাড়া দুটো ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। শুধু শুধু কেন এই দুর্যোগের মধ্যে যাবে?
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তন্ময় আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তাহলে যাব না?
আমি শুধু মাথা নেড়ে বললাম, না।
তন্ময় হঠাৎ দুহাত দিয়ে আমাকে ধরে খুব জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কাম অন, লেট আস ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ড্যান্স।
আমি ঘরের দিকে পা বাড়িয়েই বললাম, ডিনারের পর কেউ ড্রিঙ্ক করে না।
ও সব নিয়ম-কানুন আমার জন্য নয়।
কেন?
বাইরের দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তুমি আমাকে যেতে দিলে না কিন্তু ভিতরের দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে তো আমাকে মাতাল হতেই হতে
আমি থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভিতরে আবার কিসের দুর্যোগ?
তন্ময় একটু হেসে বলল, তোমার মতো আগ্নেয়গিরির…
সত্যি ভাই রিপোর্টার, সে রাত্রে আমরা দুজনেই ভালোবাসার নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি; হয়তো ইচ্ছাও ছিল না। শুধু এইটুকু জানি, সমস্ত দেহ বিদ্রোহ করতে চেয়েছিল, মন চেয়েছিল অতীতকে নতুন ইতিহাসের পলিমাটির তলায় লুকিয়ে রাখতে। এ অস্বাভাবিক অবস্থার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ হয়নি। যখন আবার স্বাভাবিক হলাম তখন ঘরে-বাইরের দুর্যোগ থেমে গেছে আর লন্ডনের আকাশ সূর্যের আলোয় ভরে গেছে।
১৬. আমার ইচ্ছায় নয়
আমার ইচ্ছায় নয়, তন্ময়ের প্রচেষ্টায় আমার জীবনে আবার মোড় ঘুরল। ডক্টর জ্যাকসন আমাকে দেখেই বললেন, মাই ডিয়ার ডটার, তুমি কালকেই অক্সফোর্ডে গিয়ে ডক্টর রবার্ট কিং-এর সঙ্গে দেখা করবে। হি ইজ লুকিং ফরোয়ার্ড টু সী ইউ অ্যান্ড টোনময়।
পরের দিনই আমি আর তন্ময় অক্সফোর্ড গেলাম। ডক্টর কিং সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। নিজে কফি তৈরি করে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে তুমি আমার ইউনেস্কো প্রজেক্টে কাজ করতে পারো। বাট ইউ উইল হ্যাভ টু লিভ ব্রিটেন।
আমি জবাব দেবার আগেই তন্ময় বলল, স্যার, তাতে কবিতার কোনো আপত্তি নেই; বরং ঘুরে-ফিরে কাজ করতে পারলে ও বেশি খুশি হবে।
দ্যা নাইস! সিগারেটে টান দিয়ে ডক্টর কিং বললেন, আমার মনে হয় কোবিটা উইল লাইক হার ওয়ার্ক।
আম বললাম, ইউনেস্কো প্রজেক্ট কাজ করা তো পরম সৌভাগ্যের কথা এবং এই সুযোগের জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসেই ল্যাভলেডিকে ফোন করে জানালাম, দুদিনের মধ্যেই বাড়ি ছাড়ছি। তারপর শাঁখা সিঁদুর না পরেই তন্ময়ের অ্যাপার্টমেন্টে উঠলাম। ওখানে থাকতে আমার আগ্রহ না থাকলেও অনিচ্ছা ছিল না। আমি জানতাম, তন্ময়ের সাহায্য দরকার। তাই কিছুটা স্বার্থপরের মতোই ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ওর আস্তানায় গেলাম।
আর্য ফ্যাক্টরির কয়েকটা সুটকেশ সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে লন্ডন এসেছিলাম। উঠেছিলাম বাঙালি অধ্যাপক ডক্টর সরকারের বাড়িতে, কিন্তু এবার আমাকে প্রথমেই যেতে হবে প্যারিস। তারপর আশেপাশের দেশগুলিতে। থাকতে হবে হোটেলে বা অন্য কোনো অস্থায়ী আস্তানায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের পক্ষে বেশ চিন্তার ব্যাপার। চিন্তার আরো কারণ ছিল। লন্ডন বিদেশ হলেও সর্বত্র কলকাতার গন্ধ পাওয়া যায়। অভাব নেই ভারতীয়দের। পথেঘাটে, বাসে-টিউবে, দোকানে বাজারে সর্বত্র ভারতীয় দেখা যায়। সুতরাং নবাগত ভারতীয়কে এখানে বিপদে পড়তে হয় না, কিন্তু প্যারিস বা রোম বা ব্রুসেল্স-এ সে সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই তো তন্ময়ের সাহায্য সহযোগিতা আমার চাই-ই। এ সব কথা ভাবতে ভাবতে নিজের কাছেই নিজেকে হীন মনে হল।
চুপ করে বসেছিলাম। বোধহয় বেশ কিছুক্ষণ। তাই তন্ময় ঘরে ঢুকেই বলল, তুমি এখনও ওইভাবে চুপ করে বসে আছ।
আমি কোনো জবাব দিলাম না।
ও আবার জিজ্ঞাসা করল, কী এত ভাবছ?
আমি মুখ না তুলেই বললাম, তোমার কথা ভাবছি।
আমার কথা? ও বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
ও হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ আমার কথা ভাবার কী কারণ ঘটল!
এবার খোলাখুলিই বললাম, এখন তোমার সাহায্য দরকার বলে ঠিক তোমার কাছে চলে এলাম। আমি জানতাম না আমি এত স্বার্থপর!
তন্ময় খুব জোরে হেসে উঠল। বলল, তুমি স্বার্থপর আর আমি মহাপুরুষ, তাই না? ও একটু এগিয়ে এসে আমার দুটো হাত ধরে বলল, কবিতা, এ সংসারে আমরা সবাই স্বার্থপর; কেউ বেশি, কেউ কম।