দোষ কী?
এবার আমি হেসে বললাম, কলকাতা ছেড়ে লন্ডন এসেছি, এই যথেষ্ট। আর আমেরিকা গিয়ে কাজ নেই।
.
ভাই রিপোর্টার, তোমাকে তো আগেই বলছি, আমার জীবনে অনেক পুরুষ এসেছেন। তাদের অনেকেই আমাকে এক এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন কিন্তু ওই বৃদ্ধ ডক্টর সরকার আর আমার কলকাতার ভাই ছাড়া আর কোনো পুরুষই নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করেননি। বাকি সবাই কিছু না কিছু কানাকড়ি নিয়েই আমাকে একটা খেয়াঘাট পার করে দিয়েছেন।
তুমি রাগ কর না। আমি জানি, এ পৃথিবীতে মেয়েদের চাইতে পুরুষের মহত্ত্ব অনেক বেশি। ভগবান যীশু, ভগবান বুদ্ধ থেকে শুরু করে এই পৃথিবীতে কত মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে তার ঠিকঠিকানা নেই। ধর্ম, ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাধনায় পুরুষদের চাইতে মেয়েরা অনেক পিছিয়ে কিন্তু তবু বলব, উবর্শী রম্ভা বা ক্লিওপেট্রার মতো লক্ষ কোটি পুরুষও ওই রকমই খ্যাতি অর্জন করলেও পুরুষ ঐতিহাসিকেরা ইতিহাসের পাতায় তাদের স্থান দেননি। শুধু নিজের অভিজ্ঞতা নয়, কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও আরো অনেক শহর-নগরের বহুমেয়ের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জোর করে বলতে পারি, বনের হিংস্র পশুর চাইতে বহু পুরুষই আরো ভয়ঙ্কর। ভদ্রলোকের মুখোশ পরে যারা থাকেন তাদের হয় সাহস নেই, নয় তো সুযোগ নেই। কলকাতার বা ভারতবর্ষের বহু নিরীহ গোবেচারা ভদ্দরলোকদের যে রূপ বিদেশে দেখেছি, তাতে ভদ্দরলোক সম্পর্কে আমার আর শ্রদ্ধা ভক্তি নেই।
তন্ময়ের সাহায্য সহযোগিতার কথা সকৃতগজ্ঞ চিত্রে চিরকাল মনে রাখব কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভুলতে পারব না তার হিংস্র লোলুপ লালসার রুদ্রমূর্তি।
১৫. পরের দুটো তিনটে দিন
পরের দুটো তিনটে দিন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। নানা জায়গায় নানা জনের সঙ্গে দেখাশুনা করে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হতো। তন্ময় নিশ্চয়ই আসত কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হতো না।
সেদিন শনিবার। কদিনের অত্যধিক ঘোরাঘুরির জন্য অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম বলে বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিলাম। হঠাৎ খুব জোরে ডোর বেল বাজতেই উঠতে হল। দরজা খুলে দেখি তন্ময়।
তুমি এখনও ঘুমোচ্ছা?
কেন? কটা বাজে?
তন্ময় একটু হেসে বলল, বেশি না, সাড়ে দশটা।
আমার চোখে তখনও ঘুম।
সেই ঘুম ঘুম চোখে একটু হেসে বললাম, ভাবছি, আরো একটু ঘুমোব।
ঘুমোও। কে বারণ করছে?
আমি সত্যি সত্যি আবার আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘুমোলাম না কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে শুয়েই তন্ময়কে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি এর মধ্যে এসেছিলে?
রোজই এসেছি কিন্তু তোমার মতো নিঃসঙ্গ সুন্দরীর সঙ্গে দেখা হবার সৌভাগ্য হয়নি।
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, বেঁচে গেছ। আমার মতো ডাইনীর সঙ্গে যত কম দেখা হয় ততই ভালো।
তন্ময় চেয়ারটা আমার বিছানার খুব কাছে টেনে নিয়ে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল, তুমি সত্যি একটা ডাইনী। তোমার পাল্লায় পড়লে কোনো পুরুষের রেহাই নেই।
আমি আবার একটু হাসি। বলি, কি হল? এই সাত সকালে হঠাৎ এত রোমান্টিক হয়ে পড়লে কেন?
ছাত্রজীবনে যাকে দূর থেকে দেখে ধন্য হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, তার এত কাছে এসেও রোমান্টিক হব না?
এখন তুমিও ছাত্র নেই, আমিও সেদিনের মতো সুন্দরী বা যুবতী নেই। তাহলে এখন আবার রোমান্টিক হবে কেন?
তন্ময় একবার আমাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, আমিও ছাত্র আছি। তুমিও সেদিনের মতো সর্বনাশী আছ।
আমি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি সর্বনাশী হলেও নিজের সর্বনাশ করেই খুশি থাকব; অন্যের সর্বনাশ করব না।
ও আমার মুখের পরে ঝুঁকে পড়ে আমার কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি কথায় কথায় এত সিরিয়াস হবে না। তুমি নিজের সর্বনাশ করতে চাইলেও আমি তা করতে দেব না।
আমি জোরে হেসে উঠে বললাম, তুমি আমার কে যে আমাকে বাধা দেবে?
তন্ময় দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বলল, তুমি যে আমার কবিতা।
আমি আবার একটু হাসলাম। বললাম, বিদেশে একলা একলা ভালো লাগছে না বলে মোহের ঘোরে কেউটে সাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো না।
আজে বাজে কথা না বলে এবার ওঠ।
কেন? বেশ তো শুয়ে আছি!
তুমি শুয়ে থাকবে আর আমি তোমার পাশে বসে থাকব, তা হয় না।
কেন?
তন্ময় হাসতে হাসতে বলল, তা আমি পারব না।
তাহলে আমিও উঠব না।
না, না, কবিতা, প্লিজ, উঠে পড়।
চা খাওয়াও। বরং আমি শুয়ে থাকি; তুমি চা করে আনো।
সত্যি তন্ময় চা করে আনল। আমি বিছানায় বসে বসেই চা খেলাম।
চা খাওয়া শেষ হতেই ও প্রশ্ন করল, ডক্টর সরকারের কাজকর্ম শেষ করতে আর কদিন লাগবে?
কেন?
কেন আবার কি? চাকরি-বাকরি করবে না?
তুমি কী কোথাও কথা বলেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কোথায়?
ঠিক কোথায় হবে জানি না; তবে ডক্টর জ্যাকসন বলেছেন, আই উইল ফিক্স হার আপ সামহোয়ার।
আমি আপন মনে বললাম, একটা চাকরি হলে ভালোই হয়। সময়টা বেশ কেটে যাবে।
এ বাড়ি কবে ছাড়বে?
আগে একটা আস্তানা ঠিক করে নিই; তারপর…
সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম, শাঁখা সিঁদুর না পরেই কি তোমার ওখানে থাকা ঠিক হবে?
তন্ময়ও হাসল। বলল, মনে মনে ইচ্ছে থাকলেও এ কথা শোনার পর আর সাহসে কুলোবে না।
.
যাই হোক, সারাটা দিন বেশ কাটল। দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট তৈরি করলাম। খেলাম। গল্প করলাম। চা খেলাম। একটু কেনাকাটা করলাম। রান্না করলাম। রান্না করতে করতে দু-তিনবার চা খেলাম। লাঞ্চ খেতে খেতে বেশ বেলা হল। দুজনে পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর তন্ময় বলল, চল, সিনেমায় যাই।