.
দেখ কবিতা, মানুষ হলেই দুঃখ পেতে হবে। এর থেকে কারুর মুক্তি নেই।
তা ঠিক, কিন্তু…
এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নেই। সব দুঃখকে হয়তো মানুষ ভুলতে পারে না কিন্তু তাকে জয় না করলে তো আমরা কেউ বাঁচব না।
আমি মুখ নীচু করে বলি, সবাই কী দুঃখ জয় করতে পারে?
হ্যাঁ, সবাই পারে; কেউ দুদিনে, কেউ দু বছরে। স্বামী হারাবার পর, সন্তান হারাবার পর, বাবা-মা হারাবার পর কটা মানুষ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়?
আমি উত্তর দিতে পারি না। তন্ময় একটু হাসে। তারপর আবার বলে, তুমি তো নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে বুড়ি বিধাবারা যত বেশি দুঃখ পেয়েছে তারা সংসারের প্রতি তত বেশি আসক্ত, তারা তত বেশি অত্যাচারী কিন্তু এত দুঃখ পাবার পর তো তাদের সন্ন্যাসিনী হওয়া উচিত ছিল।
তন্ময় ওপাশ থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসে। আলতো করে কাঁধে হাত রাখে। তারপর বলে, এই পৃথিবীর দিকে তাকাও। দেখবে দারুণ গ্রীষ্মের পরই বর্ষা; আবার পচা ভাদ্দরের পরই শরতের আনন্দ।
তন্ময়ের কথায় বড় যাদু। ওর স্পর্শে সারা শরীরে কি যেন একটা উন্মাদনা আনে। আমি তর্ক করতে পারি না, প্রতিবাদ করতে পারি না। ও আর একটু নিবিড় হয়। আমি বাধা দিতে পারি না। ওর হুইস্কীর গেলাসটা আমার ঠোঁটের সামনে ধরে, আমি চুমুক দিই।
ঠিক মনে নেই; তবে বোধহয় পুরো গেলাসটাই আমি শেষ করেছিলাম। সেই কলকাতায় কাকাবাবুর কাছে একটা হুইস্কী খাবার পর এই প্রথম হুইস্কী খেয়ে বেশ লাগল। আর ভালো লাগল ওর আলিঙ্গন, নিবিড় আলিঙ্গন আর চুম্বন। আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছা করল। সন্দীপনকে হারাবার দুঃখ ভুলতে পারলাম না কিন্তু যে বেদনা বিষণ্ণতায় মন ভরে গিয়েছিল, তার থেকে মুক্তি পেলাম। তন্ময়ের সঙ্গে দিন দশ-পনেরো মেলামেশা করার পরই হঠাৎ কলকাতা থেকে খবর এলো, ডক্টর সরকারের হোট-ভাই মারা গিয়েছেন।
খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টর সরকার বললেন, জানো মা, সন্দীপন চলে যাবার পর থেকেই মনে হচ্ছিল আমার কপালে আরো অনেক দুঃখ আছে।
ওঁকে সান্ত্বনা জানাবার ভাষা আমার ছিল না। শুধু বললাম, এখন তো আপনার অনেক কর্তব্য। ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝিদের মানুষ করতে হবে।
হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার কিন্তু মনে হয় আর ফিরতে পারব না।
আমার জন্য চিন্তা করবেন না। বোধহয় সামনের সপ্তাহেই আমি চাকরি পাব।
কিন্তু থাকবে কোথায়?
আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাকে বললেই ব্যবস্থা করে দেবে।
পরের দিনই প্যাকিং কোম্পানির লোকজন এসে ডক্টর সরকারের বইপত্তর ও অন্যান্য সবকিছু প্যাক করা শুরু করল। মালপত্র ওরাই জাহাজে কলকাতা পাঠাবে বলে দিন তিনেক পরেই উনি একদিন ভোরে বি-ও-এ-সিতে কলকাতা রওনা হলেন।
ডক্টর সরকার ভিক্টোরিয়া এয়ার টার্মিনাল থেকেই চলে যেতে বললেও আমি চলে গেলাম। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেলাম।
উনি বললেন, মা, তোমাকে এভাবে হঠাৎ ফেলে রেখে চলে যেতে হচ্ছে বলে মনে মনে বড়ই দুশ্চিন্তা রইল। তবে তোমাকে বলে রাখছি, তোমার যে কোনো প্রয়োজনে এই বুড়ো ছেলেকে মনে করলে আমি সত্যি খুশি হব।
বেশি কথা বলার মতো আমার মনের অবস্থা ছিল না। শুধু বললাম, প্রয়োজনের কথা আপনাকে ছাড়া আর কাকে জানাব? আমার তো আর কেউ নেই।
ডক্টর সরকার কোনোমতে চোখের জল সম্বরণ করে বললেন, তোমার এই বুড়ো ছেলে একাই একশো। আর কাউকে কী দরকার?
হিথরো এয়ারপোর্টের অত লোকজনের ভীড়ে আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল পড়ল কিন্তু বাড়ি ফিরে আসতেই শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতার জ্বালায় আমি হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম।
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা টের পাইনি। কোথা দিয়ে যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, তাও টের পেলাম না।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি ঘরের মধ্যে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ ওই অন্ধকারের মধ্যেই চুপচাপ বসে রইলাম। খুব ক্ষিদে লেগেছিল কিন্তু তবু শুধু নিজের জন্য কিচেনে গিয়ে খাবার-দাবার তৈরি করতে ইচ্ছা করল না।
বোধহয় ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ তন্ময় এলো। আমার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়েই বলল, বুড়ো ছেলের জন্য এত মন খারাপ কোরো না। তোমার ছেলে আবার একদিন হঠাৎ এসে হাজির হবে।
ওর কথার কি জবাব দেব? মুখ নীচু করে চুপচাপ বসে রইলাম।
দু-এক মিনিট পরে তন্ময় প্রশ্ন করল, নিশ্চয়ই এয়ারপোর্ট গিয়েছিলে?
আমি মাথা নাড়লাম।
দেখে মনে হচ্ছে, সারাদিন শুধু কেঁদেছ; খাওয়া-দাওয়া করনি।
আমি এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিই না।
তন্ময় প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে কিচেনে গেল। দুজনে মিলেই কিছু খাবার-দাবার তৈরি। করলাম। খেলাম। তারপর টুকটাক এ-কথা সে-কথার পর ও জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখানে কতদিন থাকবে?
ডক্টর সরকারের কিছু কাজ আছে বলে এ মাসটা এখানেই থাকতে হবে।
একলা একলা থাকতে পারবে?
বিকেলের দিকে তুমি রোজ একবার এসো।
তা আসব, কিন্তু…তন্ময় কথাটা শেষ করে না।
আমি একটু ম্লান হেসে বললাম, অনেক কিন্তু নিয়েই আমার জীবন সুতরাং সেজন্য চিন্তা কোরো না।
তুমি বললেই কী চিন্তা না করে থাকতে পারব?
তুমি আর কদিনই বা এখানে আছ? দু-এক মাসের মধ্যেই তো চলে যাবে।
তন্ময় হেসে বলল, তোমাকে একলা ফেলে যাব, তা ভাবলে কী করে?
তবে কী আমিও তোমার সঙ্গে স্টেট-এ যাব?