আমি লুকোবার চেষ্টা না করে বললাম, না, বিয়ের কোনো কথা হয়নি, তবে আমরা দুজনেই জানতাম, আমরা বিয়ে করব।
অনেকক্ষণ উনি কোনো কথা বললেন না। তারপর আপন মনে একটু হেসে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই এর আগে কাউকে ভালোবাসনি?
না।
উনি খুব জোর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, লোকে বলে প্রথম ভালোবাসা কখনও সাকসেসফুল হয় না। কথাটা বোধহয় ঠিকই। তারপর উনি মুখ নীচু করে বললেন, আমি তো। সেই জ্বালাতেই সারা জীবন জ্বলে পুড়ে মরছি। তুমিও এ জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে না।
এ কথার কী জবাব দেব-আমি চুপ করে বসে থাকি।
ডক্টর সরকার একটু শুকনো হাসি হেসে বললেন, জানো মা, ফার্স্ট লাভ সাকসেসফুল না হবার জন্যই আমি এত খারাপ হয়ে গেলাম। সহজ ভাবে মানুষের জীবন না এগুতে পারলেই পারভার্টেড হয়।
এইভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে মাসখানেক পার হল। ডক্টর সরকার পুরোদমে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। আমিও বাড়ির মধ্যে আর নিজেকে বন্দিনী রাখতে পারি না; বেরিয়ে পড়ি।
সেদিনও বেরিয়েছিলাম। একদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। বইপত্তর ওলটাতেই সারাটা দিন কেটে গেল। ঠিক বেরুবার মুখে একটি ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন কী? আপনার নামই কী কবিতা?…
হ্যাঁ।
আমি তন্ময় মুখার্জি।
আমি হাত জোড় করে নমস্কার করতেই উনি বললেন, আমিও আপনার কনটেম্পোরারি-তবে ইতিহাসের ছাত্র। তিনমাস হল এসেছি।
রিসার্চ করছেন?
রিসার্চ না, একটা পেপার লিখব বলে কাজ করছি। এটা শেষ করেই আমি স্টেটস এ চলে যাব।
কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে পড়লাম। এলোপাথাড়ি ঘুরতে ঘুরতে স্ট্র্যান্ড-এ চলে এলাম। টেমস-এর পাড় দিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর দুজনেই বেঞ্চে বসলাম।
তন্ময় জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে কী করছেন?
কিছু করছি না। ভাবছি একটা চাকরি-বাকরি করব।
কোথায়? কোনো ইউনিভার্সিটিতে…
না, না, কোনো ইউনির্ভাসিটিতে নয়। কোনো অফিস-টফিসে…
আপনার কী মাথা খারাপ?
কেন?
আপনি অফিসে চাকরি করবেন?
হ্যাঁ। আমি একটু হেসে বললাম, কোনো মতে দিনটা কেটে গেলেই আমি খুশি।
তন্ময় কি যেন ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কাল আপনার সঙ্গে দেখা হবে?
কেন জানি না আমি বললাম, হ্যাঁ হবে!
পরের দিনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই বাড়ি ফিরে এলাম।
১৪. পেঙ্গুইন বুকশপে একটু ঘোরাঘুরি
পরের দিন ঠিক সময় চারিং ক্রশ-এ কালেক্টস পেঙ্গুইন বুকশপে একটু ঘোরাঘুরি করতেই তন্ময়ের দেখা পেলাম। ও বেশ কয়েকটা বই কিনেছিল। তাছাড়া একটা বড় ও ভারী ব্রীফ কেস তো ছিলই। দোকান থেকে বেরুবার সময়ই ওকে অত্যন্ত ক্লান্ত মনে হল। ভাবছিলাম, বইগুলো। আমিই নেব কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তন্ময় বলল, কবিতা, বইগুলো ধরবে?
হঠাৎ ও আমার নাম ধরে কথা বলতেই আমি একটু বিস্মিত হলাম কিন্তু তা প্রকাশ না করে বললাম, নিশ্চয়ই।
বইগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েই ও রুমাল দিয়ে মুখ মুছে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। বলল, বড্ড টায়ার্ড হয়ে গেছি।
আমি কিছু বলার আগেই তন্ময় আবার বলল, এ দেশে লেখা-পড়া কাজকর্মের অনেক সুযোগ, কিন্তু বড্ড পরিশ্রম করতে হয়।
এবার আমি বললাম, এ ব্যাপারে আমার এখনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়নি, কিন্তু দেখে শুনে। তাই মনে হয়।
তন্ময় বলল, আমাদের কলকাতার অধ্যাপকরা নোটস্ লিখিয়ে লিখিয়ে এমন অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে যে বিদেশে পড়াশুনা করতে এসে বড় কষ্ট হয়।
আমি বললাম, হতে পারে, কিন্তু আমরা তো মনে করি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার চাইতে আনন্দ আর নেই।
ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, তোমার মতো বান্ধবী থাকলে নিশ্চয়ই আনন্দের।
তার মানে?
তন্ময় হাসে! বলে, তুমি তো জানো না তোমাকে নিয়ে আমাদের কত আলোচনা, কত গবেষণা হতো।
আমি বিস্ময়ের হাসি হেসে প্রশ্ন করি, আমাকে নিয়ে গবেষণা?
হ্যাঁ, গবেষণা।
আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ও বলল, তুমি আমাকে আপনি আপনি বলছ কেন? হাজার হোক এটা লন্ডন; তার ওপর আমরা সমসাময়িক।
অভ্যাস।
চেঞ্জ দ্যাট হ্যাবিট।
আই উইল ট্রাই।
ট্রাই ফ্রম নাউ অন।
আমি আর কিছু বলি না। শুধু হাসি।
কথা বলতে বলতে আমরা বাস স্টপে এসেছি। দু-এক মিনিট দাঁড়িয়েছি। তারপর বাসে উঠেছি। বাসে পাশাপাশি বসে কথা হচ্ছে।
তন্ময় বলল, সত্যি বলছি, এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন আমরা তোমাকে নিয়ে আলোচনা করিনি।
ওর কথা শুনে আমার মজা লাগে। জিজ্ঞাসা করি, এত আলোচনা কী ছিল?
তোমার মতো সুন্দরী ও বিদুষী মেয়েকে নিয়ে…
আমি সুন্দরী? আমি বিদুষী?
তন্ময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি সুন্দরী।
আমি তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম।
তন্ময় আবার বলল, কাল তোমাকে দেখে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, কোনো রাজপুত্তুর পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে তোমাকে নিয়ে অচিন দেশে চলে গেছে।
আমি হেসে বললাম, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা না করে বাংলার গল্প উপন্যাস লিখলেও আপনার ভবিষ্যত উজ্জ্বল।
আপনি নয়, তুমি!
আমি হাসতে হাসতেই বললাম, তুমি।
ধন্যবাদ!
.
যাই বল ভাই রিপোর্টার, ছাত্রজীবনের শেষে কলেজ ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে খুব ভালো লাগে। সব মানুষের কাছেই ছাত্র জীবনের স্মৃতি বড় সুখের, বড় আনন্দের। তন্ময়ের সঙ্গে আমি একই ক্লাসে পড়িনি; কিন্তু সমসাময়িক তো। তাই বিবর্ণ বিষণ্ণ জীবনের এক শূন্য মুহূর্তে ওর সঙ্গে দেখা হওয়ায় সত্যি ভালো লাগল। কিছু দিন আগে ওর সঙ্গে দেখা হলে। নিশ্চয়ই এত ভালো লাগত না। কিন্তু কক্ষচ্যুত গ্রহের মতো মহাশূন্যে তিল তিল করে জ্বলে পুড়ে ঘুরে বেড়াবার সময় ওর দেখা পাওয়ায় আমি পরম আশীবাদ বলে মনে করলাম। তুমি আমার মনের অবস্থা উপলব্ধি করবে কিনা জানি না। তবে ভাঙাচোরা নোনা ধরা বাড়িকে মেরামত করে কালার-ওয়াশ করলে যেমন ভালো লাগে, সুন্দর মনে হয়, আমিও সেই রকম বদলে গেলাম।