ওর সব চাইতে ছোট বোনটি বিধবা হয়েছে।
ইস!
আমাকে আর প্রশ্ন করতে হয় না। ডক্টর সরকার নিজেই বললেন, এই ছোটবোনকে সন্দীপন কি অসম্ভব ভালোবাসত তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাবা-মা মারা যাবার পর সন্দীপনই ওর বাবা-মা ছিল। বাড়িতে তিন-চারটে ঝি-চাকর থাকা সত্ত্বেও সন্দীপন ওকে নিজের হাতে চান করাতো, খাওয়াতো। ছোট বোন পাশে না শুলে সন্দীপন ঘুমুতে পারত না।
আমি বোবার মতো দাঁড়িয়ে চোখের সামনে যেন ওইসব দৃশ্য দেখছি।
ডক্টর সরকার থামেন না। বলে যান, বিলেত আসার বছর খানেক আগে সন্দীপনই ওর বিয়ে দিল, কিন্তু বিধাতা পুরুষ ওর স্বপ্ন চুরমার করে দিলেন।
আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কখন খবর পেলেন? তুমি বেরিয়ে যাবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই টেলিফোন এলো।
উনি কি বললেন?
শুধু সর্বনাশা সংবাদটা জানিয়েই টেলিফোন রেখে দিল।
আর কিছু বললেন না?
না। বলার মতো অবস্থা ওর ছিল না। একটু থেমে ডক্টর সরকার বললেন, আমি অনেকবার ওকে ফোন করলাম কিন্তু কোনো জবাব পেলাম না।
আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে ডক্টর সরকার বললেন, নিশ্চয়ই বেঢপ মাতাল হয়ে পাগলের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কথাটা শুনেই আমার সমস্ত বুকটা জ্বলে-পুড়ে গেল। সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে চাইলাম, ছুটে গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি, চোখের জল মুছিয়ে দিই, কিন্তু না ভাই, সে সুযোগ এলো না। কোনোদিনও আসবে না।
রাত্রে আমরা দুইজনেই আরো অনেকবার সন্দীপনকে ফোন করলাম কিন্তু ওকে পেলাম না। অনেক রাত্রে শুতে যাবার আগে ডক্টর সরকার আমাকে বললেন, একটু সজাগ থেকো। ও হয়তো পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে এখানে এসে হাজির হতে পারে।
সন্দীপনের প্রতীক্ষায় সারা রাত জেগেই রইলাম, কিন্তু না, সে এলো না। একেবারে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম-হঠাৎ ডক্টর সরকারের চিৎকার শুনেই পাগলের মতো লাফিয়ে উঠলাম। ওঁর কাছে ছুটে যেতেই উনি আমাকে দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, মা, আমার সন্দীপন নেই!
ডক্টর সরকারের আশঙ্কাই ঠিক হল। সন্দীপন বেঢপ মাতাল হয়ে পাগলের মতো গাড়ি নিয়ে ঘুরছিল সারা শহর। শেষ রাত্তিরের দিকে মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট করে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।
.
ভাই রিপোর্টার, শুনলে আমার প্রেমের কাহিনি? কেমন লাগল? এ সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা ধুলো হাতে নিলে সোনা হয়; আবার কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের ছোঁয়ায় সব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আমার এই সুন্দর দেহটার মধ্যে একটা অভিশপ্ত আত্মা লুকিয়ে আছে। তাই তো আমার দ্বারা এ পৃথিবীর কোনো মানুষের কোনো কল্যাণ হবে না, হতে পারে না। অসম্ভব।
তোমার সুন্দরীকে বোলো, পরবর্তীকালে আমার এই দেহটা অনেক পুরুষ উপভোগ করেছে। যাদের এ দেহ দিয়েছি, তাদের সবাইকে আমি ঘেন্না করি কিন্তু শুধু সন্দীপনের ওপর অভিমান করে এ দেহ তাদের বিলিয়ে দিয়েছি। পরে কেঁদেছি। অবোধ শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদেছি। হাত জোড় করে হাজার বার সন্দীপনের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
সন্দীপন মারা গেছে কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তাকে আমি সযত্নে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি। সেখান থেকেও কি সে পালিয়ে যাবে? না, তাকে আমি কোথাও যেতে দেব না। সে চিরদিনের, চিরকালের জন্য শুধু আমার।
আর লিখতে পারছি না। আমাকে তোমরা ক্ষমা কোরো। দোহাই তোমাদের, আর কোনোদিন আমার সন্দীপনের কথা জানতে চেও না!
আমার প্রাণভরা বুকভরা ভালোবাসা নিও।
১৩. সন্দীপনকে হারাবার পর
প্রিয়বরেষু ভাই রিপোর্টার,
সন্দীপনকে হারাবার পর হঠাৎ পৃথিবীটা বদলে গেল। শুধু আমার নয়, ডক্টর সরকারেরও। দুজনেই ঘরের মধ্যে বন্দী থাকতাম; একেবারেই বেরুতাম না। সারাদিন দুজনের কেউই কথা বলি না। খাবার টেবিলেও দুজনে মুখ নীচু করে খেয়েই উঠে পড়ি। শুধু তাই নয়, শোকে দুঃখে কেউই কারুর দিকে তাকাতে সাহস করি না। দুজনে দুজনের ঘরে চুপচাপ বসে থাকি; হয়তো শুয়ে পড়ি, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না। চোখের পাতা ভারি হয়ে এলেই চমকে উঠি। ওই সামান্য কটা দিনের সুখস্মৃতি যক্ষের ধনের মতো বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। বার বার সে স্মৃতি রোমন্থন করি।
কত রাত পর্যন্ত জেগে থাকি, তা বুঝতে পারি না, কিন্তু যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণই বুঝতে পারি ডক্টর সরকারও ঘুমোননি। মাঝে মাঝেই ওঁর পায়চারি করার শব্দ শুনতে পাই। যে ডক্টর সরকার প্রতি সন্ধেয় মদের বোতল নিয়ে বসতেন, সেই মানুষটা হঠাৎ মদ স্পর্শ করাও ছেড়ে দিলেন। তারপর দিন দশেক পরে উনি কিছু না বলেই সন্ধের সময় বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন মাঝ রাত্তিরের পর পাঁড় মাতাল হয়ে। আমি তো অবাক। আমাকে দেখেও যেন দেখলেন। আপন মনে এলোমেলো করে গাইছেন, কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে…।
ওঁকে যত দেখি, আমার মন তত খারাপ হয়। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু জোরে। কাঁদতে পারি না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাদি। কাঁদেন ডক্টর সরকারও। তিনি আমারই মতো চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।
এর দিন দশেক পরে ডিনার খেতে খেতে উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মা, একটা কথা বলবে? তোমার আর সন্দীপনের বিয়ের তারিখ কী ঠিক হয়েছিল?