সন্দীপন বলল, গুডমর্নিং!
গুডমর্নিং।
অনেক বেলা হয়েছে বলে ডাকতে এসেছেন? আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। আপনাকে দেখছিলাম।
ও খুশির হাসি হেসে চোখ দুটো বড় করে বলল, আমি কি টাওয়ার অব লণ্ডন যে আমাকে দেখছিলেন?
দেখছিলাম, কাল রাত্রের আপনি আর এখনকার আপনার মধ্যে কত পার্থক্য।
তাই নাকি?
আমি শুধু মাথা নাড়লাম।
দেখলেন? এখন আপনাকে কত শান্ত, স্নিগ্ধ লাগছে।
আর কাল রাত্রে?
সে তো কালবৈশাখী!
সন্দীপন হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু ওই কালবৈশাখীর ঝড়েই সব ধুলো বালি মালিন্য উড়িয়ে নিয়ে যায়।
আর আমি কথা বাড়ালাম না। বললাম, উঠে পড়ুন। আমি চা করছি।
ডক্টর সরকার তখনও ঘুমুচ্ছিলেন। আমরা দুজনে চা খাচ্ছিলাম। চা খেতে খেতে আমি ওকে বললাম, এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। আমাকে একটা চাকরি-বাকরি জোগাড় করে দিন।
আপনি ইচ্ছে করলে তে আজই চাকরি পেতে পারেন।
ইচ্ছা তো করছে কিন্তু পাচ্ছি কই।
একটু চুপ করে থাকার পর সন্দীপন জিজ্ঞাসা করল, বাইরে যেতে আপত্তি আছে?
বাইরে মানে?
লন্ডনের বাইরে।
বিন্দুমাত্র না।
ডক্টর সরকার আপত্তি করবেন না তো?
উনি কেন আপত্তি করবেন? একটু থেমে আমি বললাম, তবে ওঁর পরামর্শ নেওয়া আমার কর্তব্য।
একশোবার।
পট থেকে আরো খানিকটা চা নিজের কাপে ঢালতে ঢালতে উনি বললেন-ঠিক আছে, আমিই স্যারের সঙ্গে কথা বলব।
সেদিন নয়, পরের দিন রাত্রে খাবার টেবিলে ডক্টর সরকার আমাকে বললেন, মা, সন্দীপন তোমার জন্য একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করেছে।
আমি একটু অবাক হবার ভান করে বললাম, তাই নাকি?
আমি দেখলাম, সন্দীপন আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। কিন্তু ডক্টর সরকার তা লক্ষ্য না করেই বললেন, হ্যাঁ; তবে এখানে নয়, ওদের বিস্টলে।
এবার আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার মতো আছে?
একশোবার। বুঝলে মা, জীবনে কোনো সুযোগই দুবার আসে না।
আপনার মতো থাকলে নিশ্চয়ই যাব।
তবে মাঝে মাঝে উইক-এন্ডে এসো। তা নয়তো এই বুড়ো ছেলেকেই মায়ের কাছে ছুটতে হবে।
নিশ্চয়ই আসব।
খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা তিনজনে তিন ঘরে শুতে গেলাম। আমি, আমার ঘরে গিয়ে শাড়ি-টাড়ি ছেড়ে নাইটি পরলাম। চুল ব্রাশ করছি, এমন সময় দেখি আমার ঘরের দরজার নীচে দিয়ে একটা খাম এগিয়ে আসছে। প্রথমে একটু অবাক হলেও পর মুহূর্তে বুঝলাম, নিশ্চয়ই সন্দীপন দিয়ে গেল। যা ভেবেছিলাম, তাই। খুলে দেখি ছোট্ট একটা কাগজে লেখা, কদিন ধরেই আপনাকে একটা কথা বলতে চেষ্টা করছি কিছুতেই বলতে পারছি না।
ছোট্ট কাগজখানা হাতে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম নানা কথা। তারপর ওই কাগজেরই উল্টো দিকে লিখলাম, সে কথা কী শুধু আমাকে বলতে হবে?
দরজার নীচে দিয়ে কাগজখানা ওপাশে দিয়ে দেবার এক মিনিটের মধ্যেই জবাব এলো, হ্যাঁ, শুধু আপনাকেই সে কথা বলব!
ঠিক আছে, কাল বলবেন।
পরের দিন সকালে সন্দীপন ব্রেকফাস্ট না খেয়েই বেরিয়ে গেল। খানিকটা পরে ব্রেকফাস্ট শেষ করেই ডক্টর সরকার বেরিয়ে গেলেন। তার ঘন্টা খানেক পরেই সন্দীপন ফিরে এলো।
জিজ্ঞাসা করলাম, প্রফেসর ব্রুকস-এর সঙ্গে দেখা হল?
হ্যাঁ। স্যার কখন ফিরবেন?
বিকেলের দিকে ফিরবেন।
কিন্তু…আমার কাজ হয়ে গেছে। তাই ভাবছিলাম, দুপুরেই চলে যাব।
ডক্টর সরকারের সঙ্গে দেখা না করে যাবেন কেমন করে?
যাব না?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, না।
কাল চলে যাব?
এখানকার কাজ যখন হয়ে গেছে তখন আর শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন কেন?
সন্দীপন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না, সব কাজ হয়নি; একটা কাজ বাকি আছে।
সে কাজটা সেরে নিন।
আপনি অনুমতি দিচ্ছেন?
আমি অনুমতি দেব?
হ্যাঁ, সে কাজটা আপনার সঙ্গে।
বলুন, কী কাজ।
সন্দীপন কোনো কথা না বলে আমার দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিতেই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম। ও দুহাতে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল।
অনেক রাত হয়েছে। শুতে যাচ্ছি। পরের চিঠিতে বাকি ইতিহাস জানাব।
তুমি আর তোমার সুন্দরী আমার প্রাণভরা ভালবাসা নিও।
১২. আমার কথা শুনলে
আমার কথা শুনলে তোমরা দুজনে হয়তো হাসবে, কিন্তু ভাই বিশ্বাস কর, সেদিন সন্দীপনের বুকের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেন এই নির্মম রূঢ় পৃথিবী ছেড়ে আনন্দময় অমরাবতীতে চলে গেলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, আমি লাল বেনারসী পরেছি, মাথায় ওড়না। সন্দীপন আমাকে তার জীবনবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু করে সাতপাক ঘুরছে। আমার গলায় মালা দিল। আমি পলকের জন্য বিমুগ্ধ মনে ওকে দেখলাম। সানাই শখ আর উলুধ্বনিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে মাতাল করেছে আমাদের, চারপাশের মানুষকে। সন্দীপন একটু হাসল। দুটি স্বপ্নাতুর চোখ দিয়ে আমাকে ফিস ফিস করে বলল, কবিতা, আমার সর্বস্ব তোমাকে দিলাম।
ওই কয়েকটা অবিস্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যেই আমি অনুভব করলাম, বাসর রাত্রির আনন্দ ফুলশয্যার উন্মাদনা। দ্বিধা, সঙ্কোচ বিসর্জন দিয়ে আমি যেন আনন্দ-সমুদ্রে স্নান করলাম। মনে মনে কত কথা বললাম, কত কথা শুনলাম।
জানো কবিতা, তোমাকে প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম, ঈশান কোণের মেঘের মতো তুমি একদিন আমার সারা আকাশ ভরিয়ে দেবে।
আমিও জানতাম, এই দিগন্তবিহীন অনন্ত সমুদ্রে একদিন আমি নিজেকে তলিয়ে দেব। আর কি জানতে?