উনি খুব জোরের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কেন? তুমি কি এখানে বেশি দিন থাকবে না?
আমার অদৃষ্টে কি এত সুখ, এত ভালোবাসা সহ্য হবে?
ডক্টর সরকার হাসতে হাসতে আমার হাতটা ধরে বললেন, এ তো মায়ের মতো কথা হল না।
ওর কথায় আমার গাম্ভীর্য, আনমনা ভাব কোথায় ভেসে যায়। হাসি। বলি, না, আর বলব না।
এবার উনি বললেন, আজ আর ঘুরব না। কিছু খেয়ে-দেয়ে মার্বেল আর্চের ধারে বসে গল্প করি।
সত্যি বলছি ভাই রিপোর্টার, একজন বৃদ্ধ মানুষের সান্নিধ্য সাহচর্য হাসিঠাট্টা যে এত মধুর ও সুখের হতে পারে, তা আগে জানতাম না।
যৌবনে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের উপেক্ষা আর অনাদর করাই নিয়ম বলে জানতাম। আমাদের বয়সী একজন ছেলেমেয়েকেও কোনো বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে দেখিনি। ওরা চৈত্রের ঝরাপাতার মতো উপেক্ষিত, কিন্তু এই বৃদ্ধ ডক্টর সরকারকে দেখে জানলাম পরিণত বয়সে পরিণত মনের সৌন্দর্য ও মনের মাধুর্য সত্যি অনন্য। ভোরের সূর্য আর অস্তগামী সূর্যের রূপই যুগ যুগ ধরে অজস্র সহস্র কোটি মানুষকে বিমুগ্ধ করে রেখেছে। এই সুর্যের আলোতেই তো আমরা সবাই আলোকিত, আমাদের জীবন শক্তির প্রধান। তাই বোধহয় শৈশব আর বার্ধক্যের রূপ এত সুন্দর, এত মনোরম।
আজ হঠাৎ আমাকে জরুরী কাজে টরন্টো যেতে হচ্ছে। তাই বড্ড ব্যস্ত কিন্তু তবু তোমাকে চিঠি না লিখে পারলাম না।
তোমরা দুজনে আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।
শ্রদ্ধেয়া দিদি,
তোমার চিঠিগুলো পড়তে সত্যি খুব ভালো লাগছে। প্রথম যখন তুমি জানালে, চিঠি লিখে আমাকে তোমার বিচিত্র জীবন কাহিনি জানাবে, তখন বিশেষ উৎসাহবোধ করিনি। তোমার চিঠিগুলোর মধ্য দিয়ে শুধু তোমার বিচিত্র জীবন কাহিনিই জানতে পারছি না, জানতে পারছি। মানুষের নানা রূপ। আরো কত কি।
তোমার প্রশংসা করার জন্য এ চিঠি লিখছি না। যে কালো মেয়েটা তোমাকে দেবতার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে আর তোমার ধারণা যার জন্য আমার সব কল্যাণ ও শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই মেয়েটা হঠাৎ একটা এরোগ্রাম এনে বলল, দিদিকে একটা চিঠি লেখ।
আমি বললাম, এই তো দুতিন দিন আগে দুজনেই দিদিকে চিঠি দিলাম; আজ আবার লিখব কেন?
ও হাসতে হাসতে বলল, খুব জরুরী দরকার।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, জরুরী দরকার?
ও হঠাৎ হাসতে হাসতে আমার মুখোমুখি বসেই বলল, আচ্ছা, তুমি তো স্বীকার কর রূপে-গুণে স্বভাব চরিত্রে দিদির কোনো তুলনা হয় না।
আমি দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ঠাট্টা করে বললাম, সুন্দরী, তুমি আমার জীবনে এলে হয়তো তোমার এই দিদিকেই আমি…।
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ও রাগে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, এ ধরনের নোংরা কথা বললে আর কোনো দিন আমি তোমার কাছে আসব না।
দিদি, তুমি তো জানো, ওই কালো মেয়েটার বড় বেশি অভিমান। আর যখন অভিমান হয় তখন ওকে দেখতে আরও ভালো লাগে। আমি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর না করে পারি না। আজও তার ব্যতিক্রম হল না।
তারপর আমার কাঁধের ওপর মাথা রেখে চাপা গলায় বলল, আচ্ছা, দিদি তো এত কথা লিখছেন কিন্তু কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছেন কিনা তা তো লিখছেন না।
আমি তোমাকে সমর্থন করার জন্য বললাম, দিদি হয়তো কাউকে ভালোবাসেনি।
ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, অসম্ভব।
অসম্ভব কেন?
তুমি পুরুষ। মেয়েদের মনের কথা তুমি বুঝবে না। সব মেয়েই চায় তাকে কেউ ভালোবাসুক, আদর করুক। কোনো একজন পুরুষের কাছে সে অনন্যা হতে চায়।
তুমি চাও?
ও একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, চাই না বলেই তো সমাজ সংসার উপেক্ষা করে নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিয়েছি।
তোমাকে যখন দিদি বলে ডাকি, শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, তখন আমাদের প্রেম, ভালোবাসার বিশদ বিবরণ তোমাকে না জানানোই উচিত।
যাই হোক, সুন্দরী জানতে চায় তুমি কাকে ভালোবেসেছিলে? কেন তাকে বিয়ে করলে? সবকিছু জানাবে; তা নয়তো ওর মন ভরবে না আর আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে পাগল করে তুলবে।
আমি ওকে বলেছিলাম, তুমিই দিদিকে লেখ।
ও বললে, না, আমি এসব কথা দিদিকে লিখতে পারব না। তুমিই লেখ।
দিদি, তুমি তো জানো, আমি ওর কথায় কুতব মিনারের ওপর থেকে লাফ দিতে পারি। তাই ওর কথা মতো এই চিঠি লিখছি। রাগ করো না।
আমাদের দুজনের সশ্রদ্ধ প্রণাম নিও।
-তোমার রিপোর্টার ভাই
১১. এরোগ্রামের চিঠিটা পড়তে পড়তে
তোমার এরোগ্রামের চিঠিটা পড়তে পড়তে শুধু হেসেছি। তোমার ওই কালো সুন্দরী মেয়েটাকে আমি দেখিনি কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ওকে তত বেশি ভালো লাগছে। বিদ্যা বুদ্ধি অভিজ্ঞতা দিয়ে নয়, আমার মনের একান্ত শুদ্ধ ও নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে অনুভব করি, ও সত্যি কত গভীর ভাবে তোমাকে ভালোবাসে আর আমাকে শ্রদ্ধা করে। আমার শোবার ঘরে আর স্টাডিতে তোমাদের দুজনের দুটো বড় বড় ছবি আছে। আজ রবিবার। এই উইকএন্ডে কোথাও যাইনি। এই তিনখানা ঘরের অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যেই বন্দিনী আছি, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য নিঃসঙ্গ বোধ করিনি। রবিবার তোমাদের দুজনের পুরনো চিঠিগুলো পড়েছি আর তোমাদের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি। মাঝে মাঝে তোমাদের দুজনের ফটোটা বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছি।
যাই হোক, তোমার সুন্দরীকে বোলো, সে ঠিক কথাই বলেছে। এই পৃথিবীর সব মেয়ের মনেই স্বপ্ন থাকে, কোনো না কোনো পুরুষ আদর ভালোবাসায় তার মন প্রাণ ভরিয়ে দেবে। আমারও সে স্বপ্ন ছিল। বোধহয় সে স্বপ্ন এখনও মরে যায়নি। এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, মনের মানুষকে কাছে পেলে নিজেকে বিলিয়ে দিতাম, ভাসিয়ে দিতাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভয় হয় স্বপ্নভঙ্গের, বিশ্বাসঘাতকতার, পিছিয়ে আসি, নিজেকে গুটিয়ে নিই।