তুমি এমন সিরিয়াস হয়ে কথাগুলো বললে যে আমি অনেক চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারলাম না।
না, না, দিদি হাসির কথা নয়। আমাকে নিয়ে সত্যি ওর বড় ভয়।
কিসের ভয়?
যদি আমি ওকে ভুলে যাই। ও যদি আমাকে হারায়!
তোমার কথাবার্তা শুনে আমার ভারি মজা লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম, ওর নাম কি?
দিদি, এখনই সবকিছু বলব?
আচ্ছা, পরে শুনব।
.
আমি তোমার চেয়ে বয়সে খুব বেশি বড় না। বোধহয় আমরা দুজনেই সমবয়সী। তা হোক। তুমি সত্যি আমাকে দিদির মতো ভালোবাস, শ্রদ্ধা কর। আমিও তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসি। ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছি। প্রথমে নিশ্চয়ই একটু দ্বিধা ছিল। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তবে মনের মেঘ কেটে যেতে বিশেষ সময় লাগেনি। সেদিন বলতে পারিনি কিন্তু আজ স্বীকার করছি, প্রথম দিনই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল। তোমার চোখের দৃষ্টিতে কোনো নোংরামি দেখিনি, তোমার কথাবার্তা বা ব্যবহারে কোনো নীচতার ইঙ্গিতও পাইনি।
আজ মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি, স্নেহ করি এবং তোমার ভালোবাসায় আমি ধন্য হয়েছি। নিউইয়র্ক ছেড়ে যাবার দিন এয়ারপোর্টে তুমি আমাকে প্রণাম করলে, ছোট্ট শিশুর মতো অজোরে কাঁদলে। আমিও তোমার চিবুকে চুমু খেয়ে তোমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চোখের জল না ফেলে পারিনি। আমার মনের মধ্যে যেটুকু দ্বিধা, গ্লানি ছিল, তোমার চোখের জলে সেটুকুও ধুয়ে গেল। আজ আমি সারা পৃথিবীর সামনে গর্ব করে বলতে পারি, তুমি আমার ভাই, আমি তোমার দিদি। তোমার নিশ্চয়ই আরো অনেক দিদি আছেন কিন্তু আজ তুমিই আমার একমাত্র ভাই, বন্ধু ও আপনজন। একদিন আমিও অনেকের দিদি ছিলাম। এই সংসারের অন্যান্যদের মতো আমারও আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন নানা জায়গায়, কিন্তু আস্তে আস্তে আমি অনেক দূরে সরে এসেছি। স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে।
ইউনাইটেড নেশনস্-এর ক্যাফেটেরিয়ায় তোমার সঙ্গে আলাপ হবার পর যখন তুমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে প্রথম এসেছিলে, তখন আমাদের কি কথাবার্তা হয়েছিল, তা তোমার মনে আছে? এতদিন পর হয়তো তোমার সেদিনের কথা মনে নেই কিন্তু আমার মনে আছে। কিছু ভুলিনি।
তুমি আমার ঘরদোর-সংসার দেখার পর বলেছিলে, দিদি, তুমি বেশ আছ।
বেশ আছি মানে?
মানে ভগবান দশ হাত উজাড় করে তোমাকে সবকিছু দিয়েছেন।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি এমন দেখলে যে এ কথা বলছ?
ভগবান কি তোমাকে দেননি? বিদ্যা-বুদ্ধি, রূপ-যৌবন, অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি…।
আমি হাসতে হাসতেই আবার প্রশ্ন করি, আর কিছু?
না, না, দিদি, হাসির কথা নয়। এ সংসারে মানুষ যা যা কামনা করে, তার সবকিছুই তুমি পেয়েছ।
আমি যেন আপন মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ভগবান আমাকে সবকিছু দিয়েছেন, তাই না?
একশোবার দিয়েছেন।
আমি তোমার চিবুক ধরে আদর করে বলেছিলাম, কই, ভগবান তো এই ভাইকে আগে দেননি?
ভগবান তো তোমাদের আমেরিকার মতো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলে বসেননি যে একেবারে ঝুড়ি ভরে সবকিছু কিনে আনবেন।
আমি তর্ক না করে শুধু বলেছিলাম, ভাই, ভগবানের দোকানেও কিছু না দিয়ে কিছু পাওয়া। যায় না। আমাকে বোধহয় একটু বেশিই দিতে হয়েছে।
.
সেদিন তুমি আর প্রশ্ন করনি। আমিও আর কিছু বলিনি। বোধহয় তুমি আমার কথার তাৎপর্য বুঝতে পারনি। অবশ্য বুঝতে পারলেও সেদিন তোমাকে কিছুতেই বলতে পারতাম না। সেদিন তোমাকে ভালো লাগলেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতাম না। এখন তোমাকে সবকিছু বলতে পারি। বলব। আমি জানি তুমি আমার কোনো ক্ষতি করবে না। মনে মনে বিশ্বাস করি, তুমি তোমার দিদির দুঃখ উপলব্ধি করবে।
আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, আমি অত্যন্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অনেক অলিগলি, রাজপথ-জনপথ, অনেক মানুষ, অনেক দেশ-মহাদেশ, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আজ আমি নিউ ইয়র্কে। কিন্তু ভাই, বিশ্বাস কর, জীবনের এই পথটুকু পার হতেই আমাকে প্রত্যেকটা খেয়াঘাটে কিছু না কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। সে-সব কাহিনি আস্তে আস্তে তোমাকে বলব। না বলে থাকতে পারব না। জীবনের চরমতম গোপন কাহিনিও চিরদিনের জন্য নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায় না। অসম্ভব। আমিও আর পারছি না। দীর্ঘদিন ধরে এ বোঝা একা একা বহন করা যায় না। তাই তোমাকে সবকিছু বলে আমি একটু হালকা হতে চাই।
বাইরে থেকে সবাই আমার রূপ দেখে, যৌবন দেখে। কিন্তু এই রূপের জ্বালা, যৌবনের দাহ যে কি অসহ্য ও মর্মান্তিক, তা কেউ জানে না, জানতেও চায় না। আমার মুখের হাসি দেখেই সবাই ভাবে আমার জীবনেও কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছিল, এসেছিল শ্রাবণের ধারা, জমেছিল ভাদ্দরের মেঘ। এই সংসারে একটি নিঃসঙ্গ মেয়েকে পথ চলতে হলে যে প্রতি পদক্ষেপে কত বিপদ, কত নোংরামির মুখোমুখি হতে হয়, তা বলতেও ঘেন্না হয়। লজ্জা হয়। তবু আমি তোমাকে সব কিছুই বলব। সমাজের ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও যে কত দৈন্য, কত নোংরামি, কত নীচতা ও হীনতা থাকতে পারে, তা জানলে তুমি স্তম্ভিত হয়ে যাবে।
আচ্ছা ভাই, আমার কাহিনি শুনে আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না তো? ঘেন্না করবে না তো? খারাপ ভাবলে নাকি?
নিজের স্বপক্ষে বিশেষ কিছু বলতে চাই না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের অন্যান্য মেয়েদের মতো আমিও খুব বেশি উচ্চাভিলাষিণী ছিলাম না। বেথুন বা ভিক্টোরিয়া স্কুলের গণ্ডী পার হবার পর সাত পাকে বাঁধা পড়লেই সুখী হতাম কিন্তু বিধাতা পুরুষ আমাকে সহজ সরলভাবে এগিয়ে যেতে দিলেন না। শৈশব থেকেই বাধা দিতে শুরু করলেন। ধাপে ধাপে, প্রতিটি পদক্ষেপে। আমার জীবনে যত বাধা এসেছে, আমিও তত বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি, কিছুতেই হার স্বীকার করিনি। প্রতিটি খেয়াঘাটে কিছু সম্পদ হারিয়েছি ঠিকই কিন্তু কোনো খেয়াঘাটেই দাঁড়িয়ে থাকিনি। পার হয়েছি। আমি কি খুব অন্যায় করেছি?