শ্রাবণধারা!
ইয়েস, ইয়েস। যেমন গর্জন, তেমন বর্ষণ!
ডক্টর সরকার বোতল থেকে অমৃতধারা দুটি গেলাসে ঢালতে ঢালতে বললেন, যখন বিদেশে এসেছ, তখন একটু আধটু অভ্যেস থাকা ভালো।
চিয়ার্স!
চিয়ার্স।
গেলাসে এক চুমুক দিয়েই উনি আমাকে বললেন, তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য তোমাকে ওয়াইন খেতে দিলাম না।…
না, না, ও কথা আপনি বলবেন না।
তুমি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও সর্বোপরি যুবতী। বেশি সহজ সরল হলে বোধহয় তোমার ক্ষতি হবে। তাই…
কিন্তু শুনেছি আমাদের দেশের চাইতে এসব দেশে আমার মতো মেয়ের পক্ষে একলা থাকা অনেক ভালো।
অনেক দিক থেকে ভালো হলেও কে যেন কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তোমার ক্ষতি করবে, তা বলা মুশকিল।
আমি চুপ করে শুনি। ডক্টর সরকার একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, এখানে সবাই সম্পদ আর সম্ভোগের নেশায় মশগুল। এমন কি আমাদের দেশের মানুষও এখানে শুধু উপভোগ করতে চায়।
আমি এবারও কোনো কথা বলি না। উনি এক চুমুকে গেলাস খালি করে দিয়ে বললেন, দেখো মা, আজ তোমার বিদেশ বাসের প্রথম দিন। তোমাকে তাই সাবধান করে দিচ্ছি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে কাউকে বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা করো না।
এবার আমি বললাম, আপনি তো আছেন। আমার অত ভয় কী?
না, না, আমাকেও বিশ্বাস করো না। আজ না হোক, ভবিষ্যতে যে আমি তোমার ক্ষতি করব না, তা কে বলতে পারে?
অসম্ভব!
আবার গেলাস ভর্তি করে নিয়ে ডক্টর সরকার রুক্ষভাবে বললেন, অসম্ভব!
আমি আবার জোর করে বললাম, একশোবার অসম্ভব।
হাতের গেলাসটা নামিয়ে রেখে ম্লান মুখে বললেন, না, না, অসম্ভব না। মানুষ যে কখন। পশু হয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না।
এবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আমাকে দেখে কী খুব সাধু বলে মনে হয়?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সাধু বলে কেন মনে হবে? মনে হয়, আপনি একজন শিক্ষিত আদর্শবান মানুষ।
রাইট ইউ আর। সবাই তাই ভাবে, কিন্তু আমি তো জানি আমি কি রকম আদর্শবান।
তার মানে?
এককালে কত ছাত্রীকে যে উপভোগ করেছি…
সত্যি?
তোমাকে যখন মা বলে ডেকেছি, তখন তোমাকে মিথ্যা বলব না। তাইতো বলছিলাম, বাহির হইতে দেখো না এমন করে, আমায় দেখো না বাহিরে।
আমি একটু চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করলাম, আমিও তো কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি কিন্তু…
না, না, তারা নয়। যেসব ছাত্রীরা অধ্যাপনা করত বা আমার আন্ডারে রিসার্চ করত, তারা অনেকেই এই ব্যাচেলার অধ্যাপককে নিয়ে এমন মাতামাতি করত যে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারতাম না।
কী আশ্চর্য!
আবার আশ্চর্য হচ্ছ? এই পৃথিবীতে কোনো কিছুতেই আশ্চর্য হবে না। আমরা যাদের বেশি ভালো মনে করি, তারা যে কত খারাপ, তা ভাবা যায় না। আবার যাদের অত্যন্ত খারাপ ভাবি, তারা যে কত মহৎ হতে পারে, তা আমরা কল্পনাই করতে পারি না।
আমার গেলাস তখনও খালি হয়নি। আমার গেলাসের দিকে নজর পড়তেই উনি প্রশ্ন করলেন, একি! এখনও শেষ করোনি? চটপট শেষ করে নাও।
ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
আরেক রাউন্ড নেবে তো।
না, না, আমি আর নেব না।
তাই কি হয় মা? বুড়ো ছেলের অনুরোধ মাকে শুনতে হয়।
আমার লন্ডনবাসের প্রথম সন্ধ্যায় ওই বুড়ো ছেলের অনুরোধে আমাকে গেলাসের পর গেলাস ফ্রেঞ্চ ওয়াইন খেতে হয়েছিল। উনিও খেয়েছিলেন। আর খেতে খেতে বলেছিলেন। ওর নিজের কথা।
ডক্টর সরকার বাংলাদেশের এক বিখ্যাত জমিদার বাড়ির ছেলে। আজকের কথা নয়, প্রায় একশো বছর আগে ওদের জমিদারির আয় ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা। আর বড় জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও ডক্টর সরকারের বাবা জমিজমা বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। উনি পড়াশুনাই বেশি পছন্দ করতেন। অর্থের চিন্তা ছিল না বলে উনি কলকাতার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতেন এবং একে একে ইংরেজি, সংস্কৃত ও দর্শন শাস্ত্র নিয়ে তিনটি এম. এ. পাশ করেন!
শুনেই আমি চমকে উঠি, বলেন কী?
ডক্টর সরকার একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলেন, বাবা সত্যি পড়াশুনা ভালোবাসেন। ওকে কোনোদিন তাস-পাশা খেলতে বা আড্ডা দিতে দেখিনি।
শুনেছি, কিছু কিছু জমিদার লেখাপড়া গানবাজনা নিয়েই জীবন কাটাতেন…
আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে উনি বললেন, আর কিছু কিছু জমিদার মদ-মেয়েছেলে নিয়েই জীবন কাটাতেন।
হ্যাঁ, সেইরকমই শুনেছি।
আমার ঠাকুর্দা এই দ্বিতীয় ধরনের জমিদার ছিলেন।
আমি হাসি।
হাসছ? আমার ঠাকুর্দার কজন রক্ষিতা ছিল জানো? দশ-বারোজন।
আমি আবার হাসি। উনিও হাসতে হাসতে বলেন, ঠাকুর্দার দুজন রক্ষিতা আমাদের বাড়িতেই থাকতেন এবং আমার ছেলেবেলায় তাদের রাঙা ঠাকুমা আর গোলাপি ঠাকুমা বলে ডাকতাম।
আপনার আসল ঠাকুমা আপত্তি করতেন না?
না; কারণ সব জমিদার বাড়িতেই এ সব অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার ছিল।
আপনার বাবার মধ্যে তো এসব দোষ ছিল না।
একেবারেই না।
ডক্টর সরকার একবার মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু আমার মা বিশেষ ভালো ছিলেন না।
তার মানে?
তিনিও তো জমিদার বাড়ির মেয়ে ছিলেন। তাই আত্মভোলা পণ্ডিত স্বামী পেয়ে তিনি সুখী হতে পারেননি। আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা আর এক ম্যানেজারবাবুর সঙ্গেই…
বলেন কি?
হ্যাঁ, মা, ঠিকই বলছি। তাছাড়া মা ড্রিঙ্ক না করে থাকতে পারতেন না।
এসব কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, আমাদের পক্ষে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়।