ডক্টর সরকারের এই চিঠিখানা পড়ার পর বিদেশ যাওয়া সম্পর্কে আমিও উৎসাহ বোধ করলাম। অমিয় আর সপুর্ণাকে বললাম, সামনের মাসের সাত তারিখে আমার ভাইবা। তারপর কয়েক দিনের মধ্যেই রেজাল্ট জানতে পারব। যদি সত্যি সত্যি ডক্টরেটটা পেয়ে যাই তাহলে ভাবছি চলেই যাব।
অমিয় বলল, ভাবছি মানে? তোমাকে বিদায় না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
আমি সুপর্ণাকে বললাম, দ্যাখ, তোর স্বামীর নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। তা নয়তো ও আমাকে তাড়াবার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছে কেন?
সুপর্ণা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
অমিয় বলল, খুব স্বাভাবিক। বিদ্যাসাগর মশাইকে পর্যন্ত কত অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে। সুতরাং আমার মতো মহাপুরুষকেও যে তোমরা বদনাম দেবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
সুপর্ণা ঠোঁট উল্টে বলল, তুমি মহাপুরুষ!
এ গ্রেট ইজ নোন বাই দ্য নাম্বার অফ হিজ এনিমিজ—
আমরা তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠি।
.
ভাই রিপোর্টার, আশু মুখুজ্যে মারা যাবার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বারোটা বেজেছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আমিও ডক্টরেট পেলাম। আমার রেজাল্ট বেরুবার পর অমিয় প্রায় আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আমাকে বিলেত পাঠাবার ব্যাপারে যে কি পরিশ্রম করেছিল, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
আমার বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে এত কিছু লেখার প্রয়োজন ছিল না কিন্তু তবু আমি না লিখে পারলাম না। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ বিশেষ কাজের জন্য আসে সে কাজ শেষ হইলেই তারা চলে যায়। আমার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার জন্যই বোধহয় ও এসেছিল। তা না হলে আমি চলে আসার এক বছরের মধ্যে অমিয় ক্যান্সারে কেন মারা গেল? আমার স্থির বিশ্বাস, ও থাকলে আমার জীবনটা এমন হতাশায় ভরে যেত না।
অমিয়কে হারাবার পর আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম, এ পৃথিবীতে শুধু দুঃখ ভোগের জন্যই আমি এসেছি। আমার মুখের হাসি ভগবান কিছুতেই সহ্য করবেন না।
০৯. হঠাৎ একটা পুরনো দিনের কথা
হঠাৎ একটা পুরনো দিনের কথা মনে পড়ল। তখন সবে স্কুলে ছেড়ে কলেজে ঢুকেছি। একটু আধটু স্বাধীনতা আর নতুন বন্ধুদের নিয়ে বেশ আনন্দে দিন কাটছে। কারণে অকারণে হাসি, অহেতুক ঘুরে বেড়াই, অপরিচিতকেও পরিচিত মনে হয়। একদিন তিন-চারজন বন্ধু প্রায় জোর করেই শিখা সরকারের বাড়ি নিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম, শিখার কাকুর কাছে ওরা হাত দেখাতে এসেছে।
এসব ব্যাপারে কোনো কালেই আমার আগ্রহ ছিল না কিন্তু সবার শেষে কাকুর কাছে হাত এগিয়ে দিলাম।
আমার বেশ মনে আছে, আমার হাতের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই উনি আপন মনে বললেন, ভারি অদ্ভুত হাত!
আমরা কেউ কিছু প্রশ্ন করার আগেই শিখা জিজ্ঞাসা করল, অদ্ভুত হাত মানে?
কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, এ রকম অদ্ভুত হাত খুব কম মেয়ের হয়।
শিখা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, যা বলতে যাও, সোজাসুজি বল।
কাকু মুখ নীচু করে আমার হাত দেখতে দেখতে বললেন, তোদর সামনে বলব না। তবে তোরা জেনে রাখ, এ সবদিক থেকেই তোদর হারিয়ে দেবে।
একটা অদ্ভুত অস্বস্তি নিয়েই ফিরে এলাম এবং প্রয়োজন হলেও শিখার বাড়ি যেতাম না। বছর দুই পরে কি একটা জরুরি কারণে ওর বাড়ি গিয়ে দেখি কাকু ছাড়া আর কেউ নেই। বাধ্য হয়ে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেছিলাম।
সেদিন কাকু আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছ?
ভালো। আপনি?
আমি খুব ভালো আছি। তোমাকে এতদিন দেখিনি কেন?
ঠিক আসা হয়ে ওঠেনি।
কাকু এবার আর কোনো ভূমিকা না করে বললেন, দেখি তোমার হাতটা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত এগিয়ে দিলাম। একটা নয়, আমার দুটো হাতই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখার পর কাকু বললেন, তোমাকে দু-চারটে কথা বলছি বলে কিছু মনে করো না।
কাকুর কথায় বেশ আন্তরিকতার স্বাদ পেয়ে বললাম, না, না, কি মনে করব।
সবচাইতে বড় কথা, তুমি কাউকে হাত দেখাবে না।
কেন?
তোমার জীবনের সব কথাই তোমার হাতে লেখা আছে। এসব কথা অন্য কারুর না জানাই ভালো।
আমি চুপ করে আছি। কাকু আপন মনে আমার হাত দেখছেন। কত কি ভাবছেন। বোধহয় মনে মনে নানারকম হিসাব নিকাশ করছেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তুমি জীবনে অনেক উন্নতি করবে।…
উনি কথাটা বলতে না বলতেই আমি হাসি।
না, না, কবিতা, হাসির কথা নয়। তোমার অধিকাংশ বন্ধুদের চাইতে তুমি অনেক বেশি লেখাপড়া করবে। চাকরি-বাকরিতে এমন উন্নতি করবে যে…
আমি চাকরি করব?
নিশ্চয়ই করবে এবং তোমার কর্মজীবন বিদেশেই কাটবে।
আমি অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলি, বিদেশে!
উনি যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, তুমি বহু দুর দেশে জীবন কাটাবে এবং আজ এ কথাও বলে দিচ্ছি যে, হঠাৎ এমন একজন পরম শুভাকাক্ষীর সঙ্গে তোমার দেখা হবে, যার ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টাতেই তুমি বিদেশ যাবে।
আমি একটু হেসে বললাম, এখন তো এসব কথা আমার কল্পনার বাইরে।
তোমার জীবনে বারবার এমন ঘটনা ঘটবে বা তুমি স্বপ্নেও ভাববে না।
যেমন?
কিছু মনে করবে না?
না।
যেসব কথা বলব, তা নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারবে?
নিশ্চয়ই পারব।
শিখা বা অন্য কোনো বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকেও বলতে পারবে না।
না, কাউকে বলব না।
বারবার তোমাকে বহু পুরুষের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসতে হবে।
তার মানে?
এর চাইতে বেশি পরিষ্কার করে বলার সময় এখনও আসেনি।