অমিয় বিস্ময়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি প্রশ্ন করলাম, কি এত ভাবছেন?
অমিয় একটু হেসে বলল, ভাবছি দু-এক মাস আগে আপনার সঙ্গে আলাপ হলে কি কেলেঙ্কারি হত!
সুপর্ণা প্রশ্ন করল, কি আবার কেলেঙ্কারি হত?
আমার আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে অমিয় নির্বিকার চিত্তে বলল, ওঁর সঙ্গে আগে আলাপ হলে আমি হয় বিয়ে, না হয় আত্মহত্যা করতাম।
আমি লজ্জায় মুখ নীচু করে হাসি। সুপর্ণা হাসতে হাসতে আমাকে বলল, এই লোককে নিয়ে আমি কি করে ঘর করব, বল তো?
এবার আমি বলি, তোর ভয় নেই। আমি তোর ঘর ভাঙব না।
অমিয় বলল, আপনাকে ভাঙতে হবে না; আমিই হয়তো আমাদের ঘর ভেঙে আপনার কাছে আসব।
আমি বললাম, আসলেও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
কয়েক মাস পরের কথা। ভাইফোঁটার দিন সকালবেলায় সুপর্ণাকে নিয়ে অমিয় এসে হাজির। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার, হঠাৎ এতদিন পর এই সাত সকালে…।
অমিয় বলল, চটপট আমার কপালে একটা ফোঁটা দাও, নয়তো তোমার কাছে আসতে পারছি না।
কেন? সুপর্ণা আসতে দিচ্ছে না?
সুপর্ণা বলল, আমি কেন আসতে দেব না? ও নিজেই ভাইফোঁটা না নিয়ে তোর কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না।
কেন?
সুপর্ণা অমিয়র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বলব, কেন তুমি ওর কাছে আসতে ভয় পেতে?
অমিয় হাসতে হাসতে বলল, নির্বিবাদে।
ও বলে, বাবা, ভাই, সন্তান ছাড়া আর সব পুরুষ তোকে দেখে কামনার আগুনে জ্বলবেই।
এবার আমি লজ্জার হাসি হেসে বললাম, সুপর্ণা, তোর স্বামী এবার আমার কাছে মার খাবে।
যাই হোক সেদিন অমিয়কে ভাইফোঁটা দিলাম। তুমি শুনলে অবাক হবে এর আগে আমি আর কাউকে ভাইফোঁটা দিইনি।
ভাই বোনের সম্পর্ক যে কত মধুর, তা শুধু গল্প উপন্যাসে পড়েছিলাম; কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিল না! অমিয় আমার সে অসম্পূর্ণতার দৈন্য সত্যি দূর করেছিল। কামনা লালসার আগুনে জর্জরিত না হয়ে যে কোনো পুরুষ সত্যি আমাকে ভালোবাসতে পারে, তার প্রথম অভিজ্ঞতা অমিয়।
সন্ধের পর অফিস থেকে ফিরেই অমিয় আমাকে বলল, তোমার ওপর আমি বেশ রাগ করেছি।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
আমার অনুমতি না নিয়ে বুঝি তুমি এখানে আসতে পারো না?
আমি একটু হেসে বললাম, নিশ্চয় পারি।
তাহলে কালই চলে এলে না কেন?
আমি কোনো জবাব না দিয়ে ওর হাতের ব্রীফকেসটা টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।
অমিয় টাই-এর নট ঢিলা করতে করতে একটু মুচকি হেসে বলল, তারপর শুনছি, তুমি হস্টেলে চলে যাবে।
আমাকে দেখেই কি তোমার ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে? এবার আমি সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর স্বামী কি রকম ঝগড়া করছে, দেখছিস?
সুপর্ণা বলল, তোমাদের ভাই বোনের ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না।
অমিয় কোট খুলে বলল, কবিতা, একটা কথা শুনে রাখ। যতদিন কলকাতায় থাকবে, ততদিন এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না।
আচ্ছা যাব না। এবার তোমার শান্তি তো!
যেতে চাইলেও যেতে দিচ্ছে কে?
ভাই রিপোর্টার, অমিয় আমার জন্য কি করেছে তা বললে, অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু তবু তোমাকে বলব।
তোমার আগামী জীবনের সঙ্গিনীকে বল, অনেক দিন তার চিঠি পাইনি। তুমিও চিঠি দিও। প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।
০৮. আলো আঁধারের খেলা
এই পৃথিবীতে যেমন আলো আঁধারের খেলা চলে, আমার জীবনেও ঠিক তেমনি ভালোমন্দের খেলা চলছে। কাকুর আশ্রয় ছেড়ে আসার সময় মনে হয়েছিল, এ অন্ধকার আমার জীবন থেকে কোনো দিন কাটবে না, কিন্তু এমনই আশ্চর্য ব্যাপার যে তার পরই আনন্দে খুশিতে আমার জীবন আবার ঝলমল করে উঠল।
পাঁচ সাত দিন কেটে যাবার পর একদিন ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে অমিয় বলল, যত দিন তুমি এ দেশে থাকবে ততদিন তুমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তার মানে? এ দেশে ছাড়া আর কোন দেশে থাকব?
না তুমি এ দেশে থাকবে না।
বাজে বকো না। আমি আবার কোথায় যাব আমি হেসে বললাম, তোমাদের দুজনের ঘাড় ভেঙে যখন এমন মৌজ করে দিন কাটাচ্ছি তখন আর…।
অমিয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, সে কী? তুমি খরচাপত্র দিচ্ছ না?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি খরচ না দিলে কি তোমার একার দ্বারা এ সংসার এভাবে চলত?
যাই হক অমিয় বলল, পাসপোর্টের অ্যাপলিকেশন এলেই তুমি পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই করবে।
কেন? পাসপোর্ট দিয়ে আমি কি করব?
এ দেশে থাকলে তোমার মতো মেয়ের কপালে অনেক দুঃখ আছে। তোমাকে এখানে থাকতে হবে না।
কিন্তু বিদেশ গিয়ে আমি কি করব?
হোয়েন ইউ উইল কাম টু দ্য ব্রিজ, ইউ ইউল ক্রস দ্য ব্রিজ। এখন সেসব কথা ভাবতে হবে না।
সেদিন আর কোনো কথা হল না। ও অফিস চলে গেল।
দুএকদিন পর অফিস থেকে ফিরেই অমিয় আমাকে পাসপোর্টের ফর্ম দিয়ে বলল, এটা ফিল আপ করে রেখ। তারপর সুপর্ণার সঙ্গে গিয়ে প্যারাডাইস স্টুডিও থেকে ছবি…
কিন্তু…
সুপর্ণা বলল, অত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? তোর মতো মেয়ে বিদেশে গেলে কত সুযোগ পাবি…
হঠাৎ তোরা দুজনে আমাকে তাড়াবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস কেন?
অমিয় গম্ভীর হয়ে বলল, যদি অবিলম্বে বিয়ে করে নার্সিংহোমে ভর্তি হতে রাজি থাকিস, তাহলে অবশ্য বিদেশে না গেলেও চলবে।
আজে-বাজে কথা বললে, একটা থাপ্পড় খাবে।
মোটেও আজেবাজে কথা বলছি না; ঠিক কথাই বলছি। তোমার মতো মেয়ের পক্ষে এদেশে একলা থাকা অসম্ভব।