শ্যামল সত্যি ভালো ছেলে। যেমন স্মার্ট তেমন…
আবার আমাকে বাধা দিয়ে বলল, সব চাইতে বড় কথা ভারি সুন্দর কথা বলতে পারে।
ওর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বললেও খারাপ লাগে না।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ওর আর কি গুণ আছে?
ওর সবচাইতে বড় গুণ ও তোকে ভালোবাসে।
কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছিস? শ্যামল যে তোকে ভালোবাসে আর ওকে যে তোরও ভালো লাগে এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
.
ভাই রিপোর্টার, এ কথা তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন একটা সময় আসে, যখন সে আর নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না। নিঃসঙ্গ থাকতে চায় না। সে তখন প্রাণের মানুষকে কাছে চায়। এই শত-সহস্র লক্ষ বছরের পুরনো পৃথিবীকেই নতুন করে আবিষ্কার করতে চায়।
এ কথা সর্বজনস্বীকৃত ছেলেদের চাইতে মেয়েরাই অনেক আগে নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। করবেই। তবে কারুর দুদিন আগে কারুর দুদিন পরে।
আমার বেশ মনে পড়ে, আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখনই কয়েকজনকে দেখেছি যারা দেহে ও মনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দুতিনজন তো তখনই সংসার করার জন্য বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এ সব খুব অস্বাভাবিকও নয়। এক বিশেষ সময়েই প্রকৃতির জীবনে বসন্ত আসে কিন্তু মানুষ তো কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার দাস নয়। তার জীবনে কখন বসন্ত আসবে, তা কেউ জানে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Age does not depend upon years, but upon temperament and health সত্যি, বছরের হিসাব করলেই বয়স জানা যায় না; মন ও স্বাস্থ্যের ওপরই বয়স নির্ভর করে।
ছেলেবেলায় শুনতাম বাঙালি মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয় কিন্তু এই নিউ ইয়র্কেই এক বাঙালি মহিলা আছেন যাকে দেখে মনে হয় তিনি কোনোদিনই বুড়ি হবেন না। বেশ কবছর আগে কলকাতার একজন বিখ্যাত গায়ক এ দেশে এসেছিলেন। এক অনুষ্ঠানে তার গান শুনতে গিয়েই মিসেস চ্যাটার্জির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই দেখা হয়। ওকে নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলতেন। কেউ বলতেন, ওর স্বামী মারা গিয়েছেন, কেউবা বলতেন, উনি ডির্ভোস করেছেন। আবার এমন কথা বলতেও শুনেছি যে ওর একাধিক বিয়ে। এ সব কথা শুনে আমি হেসেছি। কারণ আমরা যতই প্রগতিবাদী হই না কেন, যতই বিলেত আমেরিকায় থাকি না কেন, একজন মেয়েকে একা থাকতে দেখলেই আমরা সমালোচনা না করে থাকতে পারি না।
সে যাই হক মিসেস চ্যাটার্জির বয়স নিয়ে আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেও কোনো কিছু জানতে পারেনি। কেউ বলেন চল্লিশ, কেউ বলেন পঞ্চাশ। অনেকে আবার বলেন, কিছু না হলেও ওর বয়স ষাট হয়েছে। বয়স যাই হক মিসেস চ্যাটার্জিকে দেখে এখনও অনেক পুরুষের চিত্ত-চাঞ্চল্য হয়। আস্তে আস্তে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হবার পর উনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, দ্যাখ কবিতা, যে মেয়েদের একলা একলা জীবন কাটাতে হবে, তাদের যৌবন আর অর্থ সব সময় মজুত রাখতে হবে।
আমি ওর কথা শুনে হাসি।
না, না, কবিতা, হাসির কথা নয়। যৌবন আর অর্থ না থাকলে আমাদের মতো মেয়েদের বেঁচে থাকাই মুশকিল।
মিসেস চ্যাটার্জি শ্যাম্পেনের গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে আবার বললেন, পৃথিবীর সব দেশের সব পুরুষরাই মেয়েদের যৌবনের মর্যাদা দেয়। আর অর্থ?
উনি একটু হাসলেন। অর্থাৎ অর্থের প্রয়োজনের কথা বলাই নিষ্প্রয়োজন।
আমার শ্যাম্পেনের গেলাস তখনও ভর্তি। ওর গেলাস খালি হয়ে গেছে। আমি আবার ওর গেলাস ভরে দিলাম।
মিসেস চ্যাটার্জি হাসতে হাসতে বললেন, হাজার হোক আমরা রামচন্দ্রের অকাল বোধনকেই যেমন সবচাইতে বড় উৎসব বলে মেনে নিয়েছি, সেই রকম জীবন যৌবনের ব্যাপারেও আমরা অকাল বোধন করতে অভ্যস্ত।
তার মানে?
আঠারো কুড়ি বাইশের পর আমাদের দেশের মেয়েরা আর যৌবন ধরে রাখতে পারে না। স্বামীর কাছে সে যৌবন উৎসর্গ করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে।
এবার আমি হাসতে হাসতে বলি, ঠিক বলেছেন।
অনেক দিন মিসেস চ্যাটার্জি সঙ্গে দেখা হয় না কিন্তু আজ তোমাকে সুপর্ণার কথা লিখতে বসে ওর কথাগুলো মনে পড়ছে। সত্যি, সুপর্ণা অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। ও মাঝে মাঝে আমাকে যা বলত তা শুনে মনে হত, ও আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারছে না। একদিন আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোর মতো বিয়ে পাগল মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।
সুপর্ণা একটু ম্লান হেসে বলল, আমার দাদা-বৌদির বেলেল্লাপনা দেখলে তুই আমার চাইতেও বেশি বিয়ে পাগল হয়ে উঠতিস।
তার মানে?
তার মানে আমি তোকে মুখে বলতে পারব না।
ওই কথা বলার পর আমি আর ওকে প্রশ্ন করিনি। এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করার সময় আমরা কেউই ভালো বা খারাপ কিছুই থাকি না। নিজেরা সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা দীক্ষা ও সর্বোপরি পরিবেশ আমাদের ভালো বা মন্দ করে। তোমরা ছেলেরা হয়তো জানতেও পারো না আশেপাশের মানুষের জন্য মেয়েদের জীবনে কি নিদারুণ সমস্যা বা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
যাই হোক, এম. এ. পরীক্ষা দেবার পরই সুপর্ণার বিয়ে হল। আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওর বিয়েতে যেতে পারিনি। বিয়ের পর ওরাও কলকাতার বাইরে চলে গেল। বোধহয় মাসখানেক পরের কথা। হঠাৎ একদিন সুপর্ণা আর অমিয় আমার ওখানে এসে হাজির।
সুপর্ণা হাসতে হাসতে অমিয়কে বলল, যে কবিতার কথা এতদিন শুধু শুনেছ, সে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।