হ্যাঁ। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
আপনি আমাকে চিনবেন না। হেমন্তবাবুর সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয়।
এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। বললাম, আপনি ভিতরে আসুন। উনি ভিতরে এলেন, বসলেন। আমি ওর সামনের সোফায় বসে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নামটা জানতে পারি?
আমার নাম রমলা।
আপনি কি কাকুর অফিসে কাজ করেন?
আপনি বুঝি হেমন্তকে কাকু বলেন?
বিচিত্র হাসি হেসে উনি এই প্রশ্ন করতেই আমার সারা শরীর জ্বলে উঠল। খুব গম্ভীর হয়ে বললাম, হ্যাঁ উনি আমার কাকু।
উনি একবার খুব ভালো করে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, আপনার কাকু তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাই দ্য ওয়ে মাইশোর সিঙ্কের শাড়িটা আপনার পছন্দ হয়েছিল তো?
ওর কথা শুনে আমার গা জ্বলে গেল। বললাম, সবই তো বুঝলাম কিন্তু আপনার পরিচয়টা জানতে পারলাম না।
আপনার মতো হেমন্তও আমার বন্ধু।
তার মানে?
রোজ অফিস ফেরত আমার কাছে যায়। আগে মাঝে মাঝে রাত্তিরটা আমার কাছেই কাটাত কিন্তু আজকাল আপনার জন্য রাত্তিরে আর আমার কাছে থাকে না।
আপনি কি এই সব আজেবাজে কথা বলতে আমার কাছে এসেছেন?
উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না। এই দিকে একটু কাজ ছিল। তাই ভাবলাম, একবার আপনাকে। দেখে যাই।
আপনার দেখা হয়েছে?
দরজার দিকে এগোতে এগোতে রমলা আরেকবার আমাকে ভালো করে দেখে বললেন, হ্যাঁ দেখলাম। বেশ লোভনীয় জিনিস।
উনি বেরিয়ে যেতেই আমি দরজা বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইলাম। কাকুর উপর রাগে দুঃখে ঘেন্নায় সারা শরীর জ্বলে গেল। তারপর মনে মনে ঠিক করলাম, না, আর এখানে নয়।
সুপর্ণাকে টেলিফোন করলাম, শোন তোর সঙ্গে আমার খুব জরুরি দরকার।
কেন, কী হল?
তোর বরকে দিয়ে আমার একটা উপকার করিয়ে দিতে হবে।
কাজটা কি, তাই বল।
তুই বাড়িতে আছিস?
আর কোথায় যাব?
তাহলে আমি আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি নিয়ে সুপর্ণার বাড়ি গেলাম। সোজাসুজি বললাম, কাকুর চরিত্র ভালো নয়। আমি আর একদিনও ওখানে থাকতে চাই না।
ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, এখন তো আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, তুই আমার এখানে চলে আয়।
দরকার হলে আসব কিন্তু তোর বরকে দিয়ে Y. W. C. A-তে আমার একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।
সে ব্যবস্থা হয়তো ও করে দেবে কিন্তু তাতে দু-এক মাস সময় লাগবেই।
কিন্তু আমি আর একদিনও কাকুর ওখানে থাকতে চাই না।
তুই আজই এখানে চলে আয়। তারপর ওখানে ঘর পেলেই চলে যাস।
তোর বরের মত না জেনে আমি আসতে পারি না।
আমার বর তোকে ওর আপন বোনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।
তা তো জানি কিন্তু তবুও তার মতামত না জেনে আমার আসা উচিত নয়।
ঠিক আছে, আজ রাত্রে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে রাখব।
তুই আমাকে টেলিফোন করিস, তবে কাকু অফিস যাবার আগে করিস না।
এগারোটা নাগাদ করব।
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
পরের দিন দুপুরের দিকে সুপর্ণা ওর বরের অফিসের গাড়ি নিয়ে আমার কাছে এলো। আমি আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হলাম। কাকুকে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে এলাম-আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। আপনার কাছে এই কবছর থেকে আমি যে অপরিসীম অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম, তা আমার ভবিষ্যত জীবনের পাথেয় হয়ে রইবে। আমি যাচ্ছি। আর কোনোদিন আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা নেই। আপনিও আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না। সব শেষে জানাই, আপনার বান্ধবী রমলা এসেছিল।
অকস্মাৎ আমার জীবন আবার মোড় ঘুরল।
তোমার দুজনে আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।
০৭. সুপর্ণার সঙ্গে আমার বিশেষ
সুপর্ণার সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের একটা ইতিহাস আছে। আমরা দুজনে একসঙ্গে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হবার কদিন পরই হঠাৎ কি কারণে যেন স্ট্রাইক হল। ভাবছিলাম লাইব্রেরিতে বসে কাজ করব কিন্তু হঠাৎ সুপর্ণা এসে অনুরোধ করল, চলুন সিনেমায় যাই। বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও ওর অনুরোধে মত দিলাম। কিছুক্ষণ এর-ওর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এসপ্ল্যানেড পাড়ায় গিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেও কোনো হলে টিকিট পেলাম না। সুপর্ণার বাড়ি ফেরার মতলব ছিল না; তাই ওকে আমার আস্তানায় নিয়ে গেলাম।
সারা দুপুর-বিকেল আমরা আড্ডা দিলাম। কত কি বললাম আর শুনলাম, তার ঠিক ঠিকানা নেই। ওই এক দুপুরবেলা আড্ডা দিতে দিতে আমরা কখন যে আপনি-তুমি পেরিয়ে তুই-এ পৌঁছেছি তা কেউই জানতে পারলাম না।
বাড়ি ফেরার আগে সুপর্ণা হাসতে হাসতে বলল, যাই বলিস কবিতা, প্রেমে পড়লে তোর এই আস্তানাটা দারুণ কাজে লাগবে।
আমিও হাসতে হাসতে জবাব দিলাম, স্বচ্ছন্দে কাজে লাগাস।
এরপর থেকে সুপর্ণা মাঝে মাঝেই ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমার ওখানে কাটিয়ে যেত। বলতো, কবিতা, একটা সত্যি কথা বলবি?
কেন বলব না?
তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে করে?
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করি, কেন? তোর বুঝি ইচ্ছে করছে?
সুপর্ণা খোলাখুলিই বলে, ঠিক বিয়ে করতে ইচ্ছে না করলেও ঠিক এ রকম একলা একলা থাকতেও ভালো লাগে না।
আমি দুহাত দিয়ে ওর মখখানা আমার দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করি, তুই কি কারুর প্রেমে পড়েছিস?
পড়িনি, তবে পড়লে ভালো হয়।
ইউনিভার্সিটিতে তো কত মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে…
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ও বলল, একমাত্র শ্যামল ছাড়া আর কারুর পাশে বসতেও ইচ্ছে করে না।