- বইয়ের নামঃ প্রিয়বরেষু
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. প্রিয়বরেষু ভাই রিপোর্টার
…অনেক ভাবনা চিন্তা করেও কি নিয়ে উপন্যাস লিখব, তা কিছুতেই ঠিক করতে পারলাম না। একটা পুরনো ডায়েরি খুঁজতে গিয়ে টেবিলের নীচের ড্রয়ারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমার এক দিদির অনেকগুলো চিঠি পেলাম। চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মনে হল, এই চিঠিগুলো ছাপিয়ে দিলেই একটা উপন্যাস হতে পারে।
আমার এই দিদির নাম কবিতা চৌধুরী। থাকেন নিউইয়র্কে। চাকরি করেন ইউনাইটেড নেশান-এ। ইউনাইটেড নেশান-এর স্পেশ্যাল কমিটির কাজে দিদিকে ঘুরতে হয় নানা দেশে। ইউনাইটেড নেশানস্-এর ক্যাফেটেরিয়ায় দিদির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর আস্তে আস্তে দুজনে দুজনের কাছে এসেছি। খুব কাছে। আজ বোধহয় দিদি আমার চাইতে কাউকে বেশি ভালোবাসেন না। বিশ্বাসও করেন না। আমি দিদিকে শুধু শুধু ভালোবাসি না, শ্রদ্ধা করি। দিদি আমার সত্যিই অনন্যা।
দিদি যখন যেখানেই থাকুন না কেন, আমাকে চিঠি লিখবেনই। কখনও ছোট। নিদেনপক্ষে পিকচার পোস্টকার্ডের পিছনে লিখবেন, ঘণ্টাখানেক সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে কাটিয়ে কলম্বো হয়ে কায়রো যাচ্ছি। ওখানে পৌঁছে চিঠি দেব। দিদি বলেন, তোমাকে চিঠি লিখতে বসলেই মনে হয়, তুমি আমার সামনে বসে বসে অথবা আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার কথা শুনছ। তাই তোমাকে চিঠি না লিখে পারি না। আমি অবশ্য খুব কমই চিঠি লিখি। মাঝে মাঝে আমরা দুভাইবোনে ভারি মজা করি। দিদি ব্যস্ততার জন্য চিঠি লিখতে না পারলে কয়েকদিনের ডায়েরির কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে দিদিকে পাঠিয়ে দিই।
যাই হোক দিদির জীবনটা বড়ই বিচিত্র। এ সংসারে সাধারণ মানুষ যা কিছু কামনা করে, সেসব কিছুই দিদির আছে। দিদির বিদ্যা-বুদ্ধি-রূপ-যৌবন যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করবেই। অর্থ প্রতিপত্তির অভাব নেই। অভাব নেই আত্মীয়-বন্ধুর। এত কিছু পেয়েও দিদির অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। এই পৃথিবীর বহু মানুষের বিরুদ্ধে দিদির অনেক অভিমান, অনেক অভিযোগ। দিদিকে হঠাৎ দেখলে, আলাপ করলে কিছু বুঝা যায় না; জানা যায় না দিদি আমার একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি।
আর বেশি লিখতে চাই না। দিদির চিঠি আর ডায়েরির ছেঁড়া পাতাগুলো পড়লেই সবকিছু জানা যাবে। দিদির নাম ঠিকানা আর অন্যান্য পাত্র-মিত্রের নাম-ঠিকানা বদলে দিয়েছি। তা নয়তো আমাদের দেশের অনেক গুণী-জ্ঞানী ও সম্মানিত ব্যক্তিরা বড়ই বিপদে পড়বেন।…
নিমাই ভট্টাচার্য
০১.
প্রিয়বরেষু ভাই রিপোর্টার,
ভেবেছিলাম এ সব কথা কোনোদিন কাউকে বলব না। কিছুতেই না। অসম্ভব। এ সব কথা বলার নয়। বলা যায় না। বোধহয় উচিতও নয়। হাজার হোক এই পৃথিবীটা এখনও পুরুষদের রাজত্ব। আমরা মেয়েরা অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক কিছু করছি কিন্তু রাজার আসনে এখনও তোমরা পুরুষরা বসে আছো ভারতবর্ষে, চীন-জাপান, ইউরোপ, আমেরিকায়। সর্বত্র।
তাছাড়া কোনোদিন ভাবিনি আমি কোনো পুরুষকে ভালোবাসব বা বিশ্বাস করব। কিন্তু তুমি আমার জীবনে এসে সবকিছু গণ্ডগোল করে দিলে। অসংখ্য পুরুষের সঙ্গে আমার আলাপ। ঘনিষ্ঠতাও আছে কয়েকজনের সঙ্গে। অধিকাংশ পুরুষ আমার কাছে এলেই কেমন যেন হিংস্র পশুর মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি শিশু নই। তাদের লোলুপ দৃষ্টির অর্থ আমি বুঝতে পারি। তাছাড়া ওরা সবাই যেন দ্বিধায়, সঙ্কোচে প্রায় শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে আমার। কাছে এগিয়ে আসেন। আর তুমি? এমন নাটকীয় ভাবে ও অপ্রত্যাশিত ঝড়ের বেগে আমার সামনে এসে হাজির হলে যে আমি কিছুতেই তোমাকে সরিয়ে দিতে পারলাম না। সেদিনের। কথা ভেবে আজও আমার হাসি পায়।
দিদি, আমি এই মহাদেশে একজন নবাগত বাঙালি সাংবাদিক।
আমি অবাক হয়ে তোমার দিকে তাকাতেই তুমি প্রশ্ন করলে, আপনিই তো কবিতা চৌধুরী?
হ্যাঁ।
তুমি নির্বিবাদে এক পেয়ালা কফি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে, ব্যস! তাহলে ভুল করিনি। কফি নিন।
কিন্তু…
দিদি বলে যখন ডেকেছি তখন আবার কিন্তু কেন? তাছাড়া আপনি অত্যন্ত সুন্দরী হলেও আমার বদ মতলব নেই। আফটার অল আমি আপনার ছোট ভাই।
সো কাইভ অফ ইউ, বাট।
আবার কিন্তু? নাও নাও, কফি খাও।
আপনি…
ছোট ভাইকে কেউ আপনি বলে? খুব বেশি সম্মান দিতে চাও তো তুমি বল। তুই বললেও আপত্তি নেই।
তোমার কথা শুনে আমি না হেসে পারলাম না। হাসতে হাসতেই কফির পেয়ালাটা হাতে নিলাম।
না, না, দিদি, হাসির কথা নয়। নিউইয়র্কের মতো শহরে তোমার মতো একজন দিদি অত্যন্ত দরকার।
কেন?
এখুনি বলব?
আপত্তি না থাকলে…
দিদি বলে যখন ডেকেছি তখন কোনো কিছু বলতেই আপত্তি নেই।
তাহলে বলুন।
আবার বলুন?
আমি একটু হাসি। বলি, হাজার হোক আমার বেশি বয়স নয়। তারপর পকেটে কয়েক শ ডলারের ট্রাভেলার্স চেক আছে। আর মাথায় কখন কোনো বদ বুদ্ধি আসে, তার কি ঠিক আছে?
কফি খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু আমার কি ভূমিকা তা তো বুঝলাম না।
হা ভগবান! ছোট ভাই অধঃপাতে গেলে দিদির কি ভূমিকা তাও বলে দিতে হবে?
কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে তুমি বলেছিলে, আরো একটা বিশেষ কারণে তোমাকে আমার দরকার।
কি সেই বিশেষ কারণ?
তুমি পকেট থেকে পার্স বের করে একটা সুন্দরী মেয়ের ফটো দেখিয়ে বললে, এই কালো কুচ্ছিত মেয়েটাকে আমি বিশেষ ভালোবাসি না, কিন্তু মেয়েটা আমাকে সত্যি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ওর ধারণা আমেরিকার সব সন্দুরী মেয়েই আমার প্রেমে পড়বে।