ইতিহাসের কাছে ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। মানুষের আসা-যাওয়ার কাহিনি চিরন্তন। নিত্য ঘূর্ণায়মান পৃথিবীতে কিছুই নিত্য নয়। কায়রো রওনা হবার আগে তরুণ তিন-চার সপ্তাহ হিস্টোরিক্যাল ডিভিশনে কাজ করেছে। শুধু মিশর বা নাসেরের নয়, সারা মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। স্তম্ভিত হয়ে গেছে ইতিহাসের দ্রুত পট-পরিবর্তনে। ভূমধ্য সাগরের চারপাশে পৃথিবীর অতীত ইতিহাসের চার আনা ঘটনা ঘটেছে। ধর্ম-সভ্যতা-সংস্কৃতি ছাড়াও কত রাজা-উজীরের আবির্ভাব ও বিদায়, কত শত শক্তিশালী শক্তির উত্থান-পতনের নীরব সাক্ষী এই শান্ত স্নিগ্ধ, সুন্দর ভূমধ্য সাগর। সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, হয়নি শুধু মানুষের আর প্রকৃতির। আমাদের দেশে পচা ভাদ্দরের পর আশ্বিনের হাসি আর শিউলির খেলা দেখান প্রকৃতি, তেমনি লীলা আছে ভূমধ্য সাগরের চারপাশে। মৃত্যুর মতো স্তব্ধ বালুকাময় অনন্তবিস্তৃত মরুপ্রান্তরের শেষ সীমায় ভূমধ্য সাগরের কোল ঘেঁষে পাওয়া যাবে মিষ্টি মাতাল হাওয়া, গাছে গাছে আছে ফল-ফুলের নিত্য সম্ভার। কেমন, মানুষগুলো? পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীরা তো ভূমধ্য সাগর বা নীল নদের জলে খেলা করেছেন যুগে যুগে।
মরুভূমির দেশগুলো যেন কেমন হয়! মরুপ্রান্তরে কোনো প্রাসাদই যেন চিরকালের জন্য নয়। শুধু পিরামিড আর প্রাণহীন মমিগুলোই যেন উত্তরকালের জন্য একমাত্র উপহার!
দিল্লিতে ব্রিফিং-এর সময় জয়েন্ট সেক্রেটারি মিঃ রঙ্গস্বামী বলেছিলেন, অতীত জানবে কিন্তু অতীত দিয়ে বর্তমানকে বিচার করো না সব সময়। আলিবাবার চিচিং ফাঁক আর পাবে না মিডল ইস্টে। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠিকমতো বর্তমানকে জানাই ডিপ্লোম্যাটদের প্রধান কর্তব্য।
রঙ্গস্বামী আরো বলেছিলেন দেখ তরুণ, আমাদের মতো ডিপ্লোম্যাটদের সব ভালো, কেউ খারাপ নয়। ইন্ডিয়া তো বিগ পাওয়ার নয় যে নিজেদের ভালো-মন্দ অপরের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবে! আলখাল্লা পরা আরবদের ভালোবাসবে, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা কোরো ওদের অতীত ইতিহাসকে।
হিস্টোরিক্যাল ডিভিশনের একজন ডেপুটি ডাইরেক্টর বলেছিলেন, সুয়েজ খাল শুধু পশ্চিমের সঙ্গে পুবের যোগসূত্র নয়। কায়রো হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান।
সত্যি তাই! ওই বিরাট বিরাট পিরামিডগুলো যেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির আর ঠান্ডা লড়াইয়ের সিংহদ্বার। নীল নদ পাড়ের ওই বিরাট সিংহমূর্তি যেন পাশ্চাত্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে সতর্ক সংকেত। কিং ফারুকের ওই বিরাট দেহটা যেন অচলায়তনের জীবন্ত প্রতিমূর্তি ছিল। তিন কোটি মানুষকে পশুর মতো অবজ্ঞা করে মদির ছিলেন ক্লিওপেট্রার স্বপ্নে। নীল নদের জল যে গড়িয়ে গড়িয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রাসাদের তলায় এসে পৌঁছেছিল, তা টের পাননি এই মূর্খ সম্রাট!
ইতিহাস বরদাস্ত করল না। যেমন বরদাস্ত করেনি নেপোলিয়ন বা মুসোলিনী বা হিটলারকে। মরুপ্রান্তরে ঝড় উঠল, অতীতের বেদুইনদের মতো বালির তলায় হারিয়ে গেলেন সম্রাট ফারুক।
তরুণ মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ইতিহাসের এই নিঃশব্দ শোভাযাত্রা। যে তিন কোটি মানুষ একদিন অভুক্ত থেকেও পিঠে পাথর টেনে প্রাসাদের পর প্রাসাদ গড়েছে, তিলে তিলে মৃত্যুকে কাছে টেনে নিয়েছে, সভ্য পাশ্চাত্যের কাছে যারা উপহাসের পাত্র ছিল, আজ তারাই বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের অন্যতম নায়ক। নীল নদের দেশের সুন্দরীদের নিয়ে যে পাচাত্যের মানুষ ছিনিমিনি খেলেছে যুগ যুগ ধরে, আজ তারাই মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের নায়িকা। ভাবলেও, দেখলেও ভালো লাগে। কায়রোয় গিয়ে বেলি ডান্স দেখাই যেন একমাত্র কাজ ছিল এই আহুত অতিথিদের। আজ কায়রোর রাস্তায় সেই পশ্চিমীরাই নায়েব-গোমস্তার মতো আরবদের মোসাহেবী করছে। দেশটাই শুধু স্বাধীন হয়নি অতীতের অত্যাচার অবিচার থেকে, মানুষগুলোও স্বাধীন হয়েছে। সভ্যতার আদিমতম সুপ্রভাত থেকে ইতিহাসের পাতায় পাতায় মিশরের উল্লেখ, কিন্তু মিশরের আরবরা এই প্রথম আত্মমর্যাদার স্বাদ পেল।
ইন্ডিয়ান এম্বাসীর কনসুলার অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাটাচি জোসেফ রসিকতা করে বলে, ভারতবর্ষ স্বাধীন কিন্তু ভারতবাসীরা পরাধীন!
মজা করে বললেও কথাটা সত্যি। জোসেফ আবার বলে, লালকেল্লায় তেরঙ্গা চড়াবার পরই তো আমাদের দেশের মানুষ সাহেব-সুবাদের পুজো করতে শুরু করল।
আর কায়রোয়? আলখাল্লা পরা আরবদের দেখলে সাহেবের দল রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াবে। কলকাতায় রবীন্দ্র জয়ন্তীতেও অনেক দেশের ভাইস-কন্সালকে সভাপতিত্ব করতে দেখা যাবে, আর কায়রোয় অমন অনুষ্ঠানের ইনভিটেশন পেলে অ্যাম্বাসেডরের দল আনন্দে নাচতে থাকেন।
কায়রোকে কোনোদিন ভুলবে না তরুণ। কাজ করার এমন আনন্দ খুব বেশি দেশে পাওয়া যায় না। লন্ডন-ওয়াশিংটন-প্যারিস-রোম বা টোকিওর ইন্ডিয়ান মিশনে প্রথম পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই অভারতীয় মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাবে। কথায় কথায় নিজের দেশের মানুষকে অবজ্ঞা দেখানো একদল ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটের প্রায় ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেনসেলভিনিয়া অ্যাভিনিউর ইন্ডিয়ান চান্সেরীতে সারা সপ্তাহে একজন আমেরিকানের আগমন হবে না, কিন্তু যে দু-চারজন ভারতীয় আসেন তাদের সঙ্গেও কথা বলার ফুরসৎ হয় না ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের। কায়রোর ইন্ডিয়ান মিশনে কালো আদমীদেরই পূজা করা হয়।