নটরাজন বিদায় নিল।
চিত্রলেখা বললো, একটু সাহায্যের জন্য এম্বাসীতে এসে আপনার নেমপ্লেট দেখে ঢুকে পড়লাম।
বলুন না কি করতে হবে?
আমার এক পুরনো বন্ধুকে স্টেশনে এক্সপেক্ট করেছিলাম কিন্তু আসেনি। স্টেশন থেকে টেলিফোন করে জানলাম ও আর ওখানে নেই। অথচ…।
নতুন ঠিকানাও জানা নেই, এবং যদি এম্বাসীতে লোক্যাল ইন্ডিয়ানদের ঠিকানা থাকে, তাহলে?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে চিত্রলেখার।
আই অ্যাম প্লিজড টু ইনফর্ম ইউ মিস সরকার, ইন্ডিয়ান এম্বাসীতে সব খবর পাওয়া যায়, শুধু ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ানদের বিষয় ছাড়া। চরম সত্যি কথাটা হাসতে হাসতে বললো সেনগুপ্ত।
মিস সরকার কথা আশা নিয়ে এসেছিলেন এম্বাসীতে কিন্তু এমন মর্মান্তিক দুঃখসংবাদ এত সহজে জানতে পারবেন, ভাবতে পারেননি। বেশ মুষড়ে পড়লেন। মুষড়ে পড়বারই কথা। সারা বছর পরিশ্রম করে মাত্র দুসপ্তাহের ছুটি। সামান্য সঞ্চয় নিয়ে মিস সরকারের মতো অনেকেই বেরিয়ে পড়েন দেশ দেখতে। এদের পক্ষে হোটেলে বা মটেলে থাকা অসম্ভব। সেনগুপ্ত সেসব জানে। একটু ভাবল, একটু দ্বিধা করল। হয়তো মনে মনে একটু বিচারও করল।
সেনগুপ্ত বলল, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রস্তাব করতাম।
না না, মনে কি করব।
যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে আমার ফ্ল্যাটে থাকতে পারেন। কোনো অসম্মান বা অসুবিধা হবে না।
সেনগুপ্তের কথাটা শেষ হবার আগেই মিস সরকার বললেন, তা তো আমি বলছি না, তবে…!
হাসতে হাসতে সেনগুপ্ত বলল, জাগ জাগ বেভেরিয়ান বিয়ার খেয়ে বেভেরিয়ান ফোক ডান্স দেখাব না। তবে আমার হাতের রান্না খেতে হবে।
কলকাতা শহরে এমন প্রস্তাব করা বা গ্রহণ করা শুধু অন্যায় নয়, অসম্ভবও। কিন্তু ব্রাসেলস্ শহরে এমন প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা সহজ নয়। তাছাড়া বছর তিনেক বিদেশে বাস করার পর আমাদের দেশের মেয়েদেরও পুরুষের সঙ্গে মিশতে অ্যালার্জি হয় না।
চিত্রলেখা মিঃ সেনগুপ্তের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল রান্না করা নিয়ে। চিত্রলেখা বলল, আমি থাকতে আপনি রান্না করবেন? অসম্ভব। তা কিছুতেই হতে পারে না।
দু-একদিনের জন্য আপনি আমার আতিথ্য গ্রহণ করায় আপনাকে খাঁটিয়ে নেব? অসম্ভব। তা কিছুতেই হতে পারে না।
তর্কবিতর্কের পর ঠিক হলো কেউই রান্না করবে না, বাইরে রেস্তোরাঁয় খাওয়া হবে। চিত্রলেখা আর সেনগুপ্ত গ্রান্ড প্লেসে ঘুরে বেড়াল, অপূর্ব গথিক স্থপতি দেখল, টাউন হলের সিঁড়িতে বসে গল্প করল। ব্রাসেলস-এর বিশ্ববিখ্যাত ওপন-এয়ার ফ্লাওয়ার মার্কেটে ঘুরল ঘন্টার পর ঘন্টা আর রেস্তোরাঁয় মহানন্দে বেলজিয়াম-বাসীদের প্রিয় হুইস্কি, সস দিয়ে গলদা চিংড়ি ও ওয়াটারজুই-চিকেনের ঝোল খেল।
ব্রাসেলস্ ত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় চিত্রলেখা নিজে হাতে রান্না করে সেনগুপ্তকে খাইয়েছিল। খাবার পর সেনগুপ্ত বলেছিল, কেন অভ্যাসটা নষ্ট করে দিলেন বলুন তো।
চিত্রলেখা বলেছিল, আপনি কি আমার কম ক্ষতি করলেন?
তার মানে?
আত্মীয়স্বজন ছাড়া বিদেশ-বিভুইতে একলা একলা বেশ ছিলাম। এই আত্মীয়তা করে কেন আমার মনটাকে খারাপ করে দিলেন বলুন তো?
আর সেনগুপ্তের? সত্যি, নিজের আত্মীয়-বন্ধু সমাজ-সংসার ছেড়ে একলা একলা বিদেশে-বাস যে কত মর্মান্তিক তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। দূর থেকে মনে হয় ডিপ্লোম্যাটরা কত সুখী। কত অফুরন্ত আনন্দের সুযোগ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ওদের কি ইচ্ছা করে না সাধারণ মানুষের হাসি-কান্নায় ফেটে পড়তে? কত কি ইচ্ছা করে।
তাই তো দুটি দিনের কাহিনি দুটি দিনেই শেষ হলো না। দুদিনের স্মৃতির সুর কানে বাজতে লাগল দুজনেরই। ডিপ্লোম্যাটকে কতরকমের হঠকারিতা করতে হয় কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, হঠকারিতা করা যে কত বেদনার, কত দুঃসহ তা সেনগুপ্তের মতো নিঃসঙ্গ ডিপ্লোম্যাট ছাড়া কেউ বুঝবে না।
হাজার হোক হিউম্যান মেটিরিয়্যাল, মানুষ নিয়েই ডিপ্লোম্যাট ও ডিপ্লোম্যাসি। তাই তো মাঝে মাঝে মনটা উড়ে যায় চালেরী বিল্ডিং থেকে অনেক দূরে, ঘুরে বেড়ায় টুকরো টুকরো স্মৃতির রাজ্যে। চিত্রলেখার চিত্রকে ঘিরে।
তরুণ এসব জানে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে, আগ্নেয়গিরির আগুন যেমন সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, ডিপ্লোম্যাটদেরও মনের দুঃখ, প্রাণের আক্ষেপ নজরে পড়ে না। স্মৃতির জ্বালায় দগ্ধ হবে কিন্তু কর্তব্যে ত্রুটি হলে ক্ষমা নেই, মার্জনা নেই। হয়তো একটা গোপন খবর বেফাঁস বেরিয়ে যেতে পারে, একটা গোপন সংবাদ জানতে পেরেও ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে ভুলে যেতে পারে। হতে পারে অনেক কিছু, কিন্তু শিকার ফসকে গেলে ডিপ্লোম্যাটের ক্ষমা নেই।
০৩. কায়রো এয়ারপোর্টে কয়েক ঘণ্টা
এর আগেও যখন কায়রো এয়ারপোর্টে কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার বিদায় নিয়েছে, তখন তরুণ ভাবতে পারেনি পরের বার এমন পরিবর্তন দেখবে। এই কায়রো এয়ারপোর্ট! এত বড়, এত চমৎকার!
এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটা কায়রো এয়ারপোর্টের দীর্ঘ রানওয়ে পার হতে হতেই তরুণ জানলা দিয়ে অবাক বিস্ময়ে শুধু এয়ারপোর্ট টার্মিনাল বিল্ডিংটাই দেখছিল। বিস্ময় যত বেড়েছে টার্মিনাল বিল্ডিং তত কাছে এসেছে। সুন্দর স্যান্ডস্টোনের অপূর্ব আধুনিক বিল্ডিং। লম্বায় প্রায় এসপ্লানেড-ধর্মতলার মোড় থেকে পার্ক স্ট্রিট হবে। স্ফিংকস-পিরামিডের দেশ যে এমন করে সারা দুনিয়াকে চমকে দেবে, কেউ ভাবতে পারেনি।