সমস্ত কর্মজীবন ধরে বার বার যে দৃশ্যটির মুখোমুখি হতে হয়, সেই দৃশ্যটি আবার হাজির হলো। সবার মনই ভারি, চোখগুলো সবারই যেন একটু চচক করছে। মুখে কারুরই বিশেষ কথাবার্তা নেই। একেবারে শেষ মুহূর্তে তরুণের কাঁধে একটা ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে মিঃ ট্যান্ডন বললেন, বেস্ট অফ লাক।
থ্যাংক ইউ স্যার। কলিগদের দিকে ফিরে বলল, থ্যাংক ইউ অল।
.
ব্রিটিশ ইউরোপীয়ন এয়ারওয়েজের প্লেনটা লন্ডন এয়ারপোর্টের উপর ঘুরবার সময় বন্দনা-বিকাশের কথা মনে হতেই একটু ভালো লাগল। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়েই যেমন সূর্যরশ্মি বেরিয়ে আসে, তেমনি অনেক খুশির মধ্যেও দিল্লি বার্লিনে এয়ারপোর্টের দৃশ্য বার বার মনে পড়ল।
টার্মিনাল বিল্ডিং-এ ঢুকতে গিয়েই তরুণ উপরে ভিজিটার্স গ্যালারীর দিকে তাকাল। হ্যাঁ, বন্দনা আর বিকাশ আনন্দে উল্লাসে হাসতে হাসতে দু হাতই নাড়ছে। হাই-কমিশনের কয়েকজন বন্ধু ও কর্মচারীও এসেছিলেন।
হাই-কমিশনের একজন স্টাফ কাস্টমস এনক্লোজারে গিয়ে ফার্স্ট সেক্রেটারি-ডেজিগনেট এসেছেন জানাতেই সঙ্গে সঙ্গে তরুণের মালপত্র ছেড়ে দিলেন ওঁরা।
বাইরে আসতেই বন্দনা টিপ করে একটা প্রণাম করল। দেখলে দাদা, শেষ পর্যন্ত আমার কথাই ঠিক হলো।
পুরনো বন্ধু মিঃ মানি বললেন, ফিরে এসে বাঁচালে!
কেন?
ছেলেমেয়েকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে একটু ফুর্তি করা যাবে।
তরুণ হাসতে হাসতে জবাব দেয়, সারা জীবনই কি তোমাদের আয়াগিরি করব?
হাই-কমিশনের একজন স্টাফ জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার, লগেজ গাড়িতে রেখে দিয়েছি। আপনি এখন আপনার অ্যাপার্টমেন্টে যাবেন তো?
হ্যাঁ।
বন্দনা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, সে কি দাদা? আগে আমার ওখানে চলো।
তার চাইতে তোমরা আমার সঙ্গে চলো। একটু দেখে শুনে নিয়ে তারপর তোমার ওখানে যাব।
বিকাশ বলল, হ্যাঁ, তাই ভালো।
তরুণ বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল। বন্দনা বিকাশও উঠল।
লন্ডনের জীবনটা বেশ ভালোই শুরু হলো। অফিসে কাজকর্মের চাপ বেশি হলেও ভালো লাগে। তাছাড়া বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রথম তিন চারদিন তো নিশ্বাস ফেলার অবকাশ পেল না। লাঞ্চেও বেরুত না, উপরের রেস্তোরাঁ থেকে কিছু আনিয়ে খেত! অফিস থেকে বেরুতে বেরুতেও অনেক দেরি হতো। সাড়ে সাতটা-আটটা বেজে যেত।
টুকটাক কিছু মার্কেটিং করার ছিল। সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বেরুবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু অফিস থেকে বেরোবার আগেই হঠাৎ একটা টেলিফোন এলো, তরুণ, আমি ওবেদুর।
ওবেদুর যে এখনও লন্ডনে আছে, তা ও ভাবতে পারেনি। অপ্রত্যাশিত এই টেলিফোন পেয়ে ভীষণ খুশি হলো, আমি ভাবতেই পারিনি তুমি এখনই লন্ডনেই আছ।
হালারা ট্রান্সফার করার চেষ্টা করছিল।
এতদিন পরেও পূর্ববঙ্গের পোলাদের ওরা চেনেনি?
হালারা চেনে বলেই তো আমাদের একটু দূরে দূরে রাখে।
ওবেদুর একটু থেমে বলে, আজ আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে গান-বাজনা আছে। তুমি নিশ্চয়ই যাবে। আইদার ইউ কাম টু মাই অফিস অর আই উইল কাম ডাউন টু পিক ইউ আপ।
ভাই আজকে মাপ করো। আজকে আমার একটু জরুরি কাজ আছে, কদিন একেবারেই সময় পাইনি।
এক্ষুনি একজনের কাছে শুনলাম তুমি এসেছ এবং সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন করেছি। আর তুমি আমার ফার্স্ট রিকোয়েস্টই…
তরুণ বাধা দিয়ে বলল, আঃ! এসব কথা বলছ কেন? তোমার সঙ্গে আমার সেই সম্পর্ক?
এবার ওবেদুর সোজা হুকুম করে, দেন প্লিজ ডোন্ট আরণ্ড এনি মোর। তুমি সাতটা নাগাদ আমার এখানে আসছ তো?
ওবেদুর রহমান ময়মনসিং-এর ছেলে। তবে তরুণের সমসাময়িক। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনসের লন্ডন অফিসের ম্যানেজার বহুদিন ধরে। বাঙালি ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাগলামি করতে ওর জুড়ি নেই লন্ডনে। তরুণের সঙ্গে বেশ গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল গতবার। এমন বন্ধুবৎসল উদার মানুষ টেম-এর পাড়ে দুর্লভ। কিছুতেই না করতে পারল না। তাছাড়া এতকাল বার্লিনে থেকে বাঙালির আড্ডাখানা ভুলতে বসেছে।
একে আড্ডার লোভ, তারপর ওবেদুরের অনুরোধ। তরুণ রাজি হয়ে গেল।
ঠিক আছে।
অফিস থেকে বেরুবার আগে বন্দনাকে টেলিফোন করে বলল, আমি ওবেদুরের সঙ্গে এক ঘরোয়া জলসায় যাচ্ছি। নিশ্চয়ই রাত হবে। তুমি আমার জন্য কিছু খাবার-দাবার রেখো।
কোথায় যাচ্ছ, দাদা?
ঠিক জানি না। ওবেদুরেরই এক বন্ধুর বাড়ি।
অফিস থেকে বেরুবার মুখে হঠাৎ একটা কাজ এসে গেল।
বেরুতে বেরুতেই সাতটা বেজে গেল। ওবেদুরের ওখানে পৌঁছতেই ও চিৎকার শুরু করে দিল, আড্ডা দিতেও কেউ লেট করে?
একটা মুহূর্ত দেরি করল না ওবেদুর। চলো চলে, গাড়িতে ওঠ। আরেক দিন এসে কফি খেও।
উঠতে না উঠতেই ওবেদুরের অস্টিন-কেম্ব্রিজ টপ গিয়ারে ছুটতে শুরু করল। আশেপাশের আর সব গাড়িকে ওভারটেক করে এমন স্পিডে গাড়ি ছুটছিল যে তরুণ ওবেদুরের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলারই কোনো সুযোগ পেল না। টটেনহাম কোর্ট ছাড়াবার পর তরুণ শুধু জানতে চাইল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ওবেদুর শুধু বলল, এইত সামনেই হোবনে।
হোবর্ন টিউব স্টেশন পার হবার পরই ডানদিকে গাড়ি ঘুরল। আবছা আলোয় তরুণ বুঝতে পারল না কোন রাস্তায় ঢুকল। শত খানেক গজ যাবার পরই অনেকগুলো গাড়ি নজরে পড়ল। ওই গাড়িগুলোরই একটু ফাঁকে ওবেদুর গাড়ি ঢুকিয়ে ব্রেক করল।
দুজনেই নেমে পড়ল। গাড়ির চাবিটা পকেটে পুরেই সিগারেট বের করল ওবেদুর। দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে দু-চার পা এগিয়েই একটা কর্নারের বাড়িতে এলো। সামনের ঘরেই একদল বাঙালির জটলা। দরজার গোড়াতেই ভিতরের দিকে মুখ করে আরেকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন এক ভদ্রলোক।