হ্যাঁ।
বড়ুয়া একটু হাসল। আপন মনেই বলল, পাকিস্তানিদের ঢং দেখে হাসি পায়!
তার মানে?
সব খবর-টবর হাতের মুঠোয় থাকার পরও এইসব ন্যাকামির কোনো মানে হয়?
একটু হেসে বড়ুয়া আবার বলে, ব্রাদার, গেট রেডি। শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডের কয়েক হাজার টাকা অ্যাভান্স নিলেই চলবে না। বেশ কিছু খসাতে হবে। নইলে কেউ তোমাকে ছাড়বে না।
শুধু বড়ুয়া বা রানি নয়, মিনিস্ট্রির অনেকেই সে কথা বললেন, তরুণ, আমাদের ফাঁকি দেবার চেষ্টা করো না কিন্তু।
না না, ফাঁকি দেব কেন?
ডোন্ট প্রমিস্ লাইক এ প্রমিসিং ডিপ্লোম্যাট।
শুধু অফিসাররাই নয়, মিনিস্ট্রির নানা ডিপার্টমেন্টের অনেক পরিচিত কর্মচারীও বললেন, দাদা, শুধু আপনি বলেই আমরা এত খাটছি।
থ্যাংক ইউ।
নো নো দাদা, শুধু থ্যাংক ইউ বললেই চলবে না।
সবার মুখেই ওই এক কথা। শুনতেও যেন ভালো লাগে।
দিনগুলো বেশ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। যমুনাকে দেখতে যেতেও পারেনি। আর মাত্র দুটি দিন হাতে। সেদিন মিনিস্ট্রি থেকে যমুনাকে টেলিফোনে জানিয়ে দিল, বিকেলের দিকে ঠিক হয়ে থাকবে। আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।
লাঞ্চের সময় রানিকে বলল, আজ বিকেলে যমুনাকে নিয়ে আসব। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডিনার খাইয়ে দিয়ে আসব।
রানি বলল, ঠিক আছে।
আমি তোমাদের গাড়িটা রেখে যাচ্ছি। তুমি পম্পিকে আনার পর চলে এসো অফিসে। তারপর দুজনে মিলে যমুনাকে আনতে যাব।
রানি কিছুতেই গাড়ি রাখতে রাজি হলো না। বড়ুয়াও বারণ করল, না না, তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। যমুনাকে আনতে যাবার আগে রানিকে তুলে নিও অথবা ও ট্যাক্সি নিয়েই সাউথ ব্লকে পৌঁছে যাবে।
সেদিন যমুনাকে নিয়ে আর পরের দিন মিনিস্ট্রির সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে নিতেই কেটে গেল। একবার ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গেও দেখা করল। রাত্রে তরুণের অনারে বড়ুয়া আর রানি ডিনার দিল।
.
দিল্লি ত্যাগ করার সময় মনটা ভীষণ খারাপ লাগছিল তরুণের। এত বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, সহকর্মী ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বেশ বুঝতে পেরেছে, ওরা সবাই ওকে কত ভালোবাসে, শুভ কামনা করে।
বড়ুয়া পর্যন্ত এসেছিল পালামে বিদায় জানাতে। অনেক বারণ করা সত্ত্বেও বাধা মানেনি। বলেছিল, রানিই তো ড্রাইভ করবে, সুতরাং আমার যেতে আপত্তি কি?
বড়ুয়ার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে তরুণ বিদায় নিল। পম্পিকে একটু বুকের মধ্যে টেনে নিল। রানির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে শুধু বলেছিল, চলোম। চিঠি লেখো।
সবার চোখই ছলছল করছিল! কথাবার্তা বিশেষ কেউই বলতে পারল না।
যমুনা পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল কিন্তু মুখে কিছু বলেনি।
প্লেনটা পালামের মাটি ছেড়ে অনেক দূরে উড়ে যাবার পরও তরুণ উদাস দৃষ্টিতে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। কেবিন হোস্টেস কফি দেবার পর দৃষ্টিটা গুটিয়ে আনল ভিতরে।
যমুনা বলেছিল, আপনি ওদের সবাইকে খুব ভালোবাসেন তাই না?
মাথাটা একটু নাড়িয়ে তরুণ বলল, ওরাই আমাকে ভালোবাসে।
কফি শেষ করে যমুনা আবার জিজ্ঞাসা করে, আংকেল, আপনি তো লন্ডনে ট্রান্সফার হচ্ছেন।
হ্যাঁ!
আমি কিন্তু উইক-এন্ডে আপনার কাছে চলে আসব।
তুমি এলে তো আমি খুশিই হবো।
আপনি একটু বাবাকে বলে রাখবেন।
তরুণ হাসে। বলব।
পম্পি, যমুনার মতো বন্ধু-বান্ধব-সহকর্মীদের ছেলেমেয়েদের কাছে পেলেই তরুণের মনে আসে অনেক কথা, অনেক স্বপ্ন। ইন্দ্রাণীকে পেলে ওরও ছেলেমেয়ে এতদিনে বড় হতো, লেখাপড়া করত। ভাবে, ইন্দ্রাণীর মেয়ে হলে এই পম্পি-যমুনার মতোই দেখতে সুন্দর হতো, বুদ্ধিমতী হতো।
স্বপ্ন দেখতে দেখতে মন উড়ে যায় সীমাহীন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। প্লেন ছুটেছে তেহেরানের দিকে। ফ্রাঙ্কফুর্টের আগে এই একটাই স্টপেজ। সেই তেহেরানও পার হয়ে গেল। পার হলো আরো কত দেশ-দেশান্তর।
অ্যাম্বাসেডর সস্ত্রীক ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে এসেছিলেন যমুনাকে রিসিভ করতে। দুজনেই বার বার ধন্যবাদ জানালেন তরুণকে।
একথা বলে লজ্জা দেবেন না, স্যার। দিল্লিতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে যমুনাকে নিয়ে একটুও ঘুরতে পারিনি।
হঠাৎ মাঝখান থেকে যমুনা বলে উঠল, বাট আংকেল, দ্যাট ডে উই অল এনজয়ে ভেরি মাচ।
অ্যাম্বাসেডর হাসতে হাসতে বললেন, তরুণ, ডিপ্লোম্যাট হয়েও হেরে গেলে। ক্যাট ইজ আউট অফ দি ব্যাগ।
একটু পরেই প্যান অ্যামেরিকানের বার্লিন ফ্লাইট। তরুণ সেই প্লেনেই যাবে। অ্যাম্বাসেডরের পার্সেন্যাল অ্যাসিসট্যান্ট তরুণের লগেজ ট্রান্সফার চেক করতে ও বোর্ডিং কার্ড আনতে চলে গেল। সেই অবসরে অ্যাম্বাসেডর আর তরুণ একটু দূরে গিয়ে কিছু গোপন কথাবার্তা বললেন।
তরুণের প্লেন ছাড়ার আগে অ্যাম্বাসেডর বললেন, যমুনাকে পৌঁছে দিতে হয়তো আমিই লন্ডন আসব! আই মাইট স্টে উইথ ইউ।
আই উইল বি গ্রেটফুল ইফ ইউ প্লিজ।
বার্লিন বাসের মেয়াদ মাত্র দুটি দিন। ফেয়ারওয়েল লাঞ্চ-ডিনারের জন্যই ওই দুটো দিন হাতে রেখেছিল তরুণ। আর কোনো কাজ নেই। লগেজের ঝামেলা ওর কোনো কালেই নেই। কিছু জামা-কাপড়, বই-পত্তর আর একটা মুভি ছাড়া আর কিছু নেই ওর। মিঃ দিবাকর সেসব কদিন আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন লন্ডনে।
প্রথম দিন দুপুরে কলিগদের লাঞ্চ, রাত্রে ট্যান্ডন সাহেবের ডিনার হলো। পরের দিন তরুণ ঘুরে ঘুরে সমস্ত কলিগদের বাড়ি গেল, বিদায় নিল, শুভেচ্ছা বিনিময় করল। রাত্রে কনসুলেটেই ও ডিনার দিল ট্যান্ডনদম্পতি ও অন্যান্য সব কলিগদের জন্য।