চিঠির শেষে দেশাই লিখেছে, মনে হয় ঢাকাতে আর বিশেষ কিছু করণীয় নেই। তবে যদি করণীয় থাকে, জানাতে দ্বিধা করবেন না। তাছাড়া ডি-আই-জির পুরো রিপোর্টটা পড়ে দেখবেন! ঢাকার বহুলোকের মন্তব্য ও রেফারেন্স আছে এবং আপনি হয়তো অনেককে চিনতে পারেন।
ডি-আই-জির রিপোর্টের মূল বক্তব্য পড়ে নতুন সন্দেহের মেঘ জমল তরুণের মনে। তবুও যেন অনেকটা আশ্বস্ত হলো। কৃতজ্ঞতা বোধ করল দেশাই-এর প্রতি। কেবল করে ধন্যবাদ জানাল, কাইন্ডলি অ্যাকসেপ্ট সিনসিয়ারেস্ট থ্যাংকস্।
কিন্তু কে এই আজিজুল ইসলাম? প্লিডার? তরুণের বাবাও তো ওকালতি করতেন। কিছু কিছু উঁকিলের সঙ্গে তো ওরও পরিচয় ছিল, কিন্তু আজিজুল ইসলাম?
না।
উয়াড়ির ওদিকে হবিবুর ইসলাম বলে একজন উকিল ছিলেন। আর কোনো ইসলাম নামে উকিল ছিলেন কি?
অনেকক্ষণ ভাবল। হঠাৎ মনে পড়ল, ওবেদুর ইসলাম সাহেব তো ওর বাবার কাছে মাঝে মাঝে আসতেন।
কিন্তু আজিজুল ইসলাম নামে কোনো উকিলকে কিছুতেই মনে পড়ল না। আশেপাশে ঢাকার কোনো লোকও নেই যে খোঁজ-খবর করা যাবে। বার্লিনে বাঙালি নেই বললেই চলে। লন্ডন, নিউইয়র্ক হলে ঢাকার কতজনকে পাওয়া যেত। এমন বিশ্রী জায়গা এই বার্লিন।
অন্য জায়গাতে পাকিস্তান মিশনে কত ঢাকার লোক পাওয়া যায়। এখানে তাও নেই।
আজিজুল ইসলামের চিন্তা করতে করতেই দিল্লি রওনা হবার সময় এসে গেল।
প্লেনে দিল্লি যাবার সময়ও ওই কথাই ভাবছিল, আজিজুল ইসলাম! তেহেরান এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে বসেও ভাবছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, আবাল্য বন্ধু মৈনুল ইসলামের কথা। ওর বাবার নাম ছিল তো আজিজুল ইসলাম।
কিন্তু?
কিন্তু তিনি তো মুনসেফ ছিলেন, উকিল ছিলেন না। ডি-আই-জি ভুল করে মুনসেফকে উকিল বলে লেখেননি তো?
মৈনুলদের পরিবারেই কি ইন্দ্রাণী স্থান পেয়েছিল? মৈনুলের মাকে তরুণও আম্মাজান বলে ডাকত। ভদ্রমহিলার বেশ চুল পেকে যায়। ভারি ভালো লাগত দেখতে। আম্মাজানকে কি জ্বালাতনই না করেছে ওরা!
২১. সান্তাক্রুজ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে
অনেক দিন পর সান্তাক্রুজ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে বেশ ভালো লাগল। হাজার হোক ভারতবর্ষ! নিজের দেশ! বহুদিন ধরে বহু দেশ ঘুরে নিজের দেশে ফিরে এলে সবারই ভালো লাগে।
কেবিনের অন্যান্য প্যাসেঞ্জারেরা চলে যাবার পর আস্তে আস্তে তরুণ উঠল। উপরের র্যাক থেকে ওভারকোটটা হাতে নিল। ব্রিফকেসটাও তুলে নিল আরেক হাতে।
গ্যাংওয়ের মুখে এয়ার হোস্টেস সারা রাত্রির ক্লান্তি সত্ত্বেও একটু হাসল। গুডবাই স্যার।
তরুণ অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দিল, বাই।
যমুনা এসেছিল এয়ারপোর্টে।
কাস্টমস এনক্লোজারের বাইরে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তরুণ চিনতে পারেনি। চিনবে কেমন করে? সেই ছোট্ট যমুনা যে এত বড় হয়ে গেছে, ভাবতে পারেনি।
যমুনাই দৌড়ে গিয়ে ডাকল, আংকেল, আই অ্যাম হিয়ার।
তুমি যমুনা?
যমুনা হাসতে হাসতে বললো, কেন, সন্দেহ হচ্ছে?
না। তবে তুমি কত বড় হয়ে গেছ!
যাদের ছোট্ট দেখা যায়, দেখা যায় হামাগুড়ি দিতে, টফি চকোলেট-আইসক্রীম নিয়ে মারামারি করতে, অনেক দিনের অদর্শনের পর তাদের বড় দেখলে ভালো লাগে। সেই বহু দূরের একটা ছোট্ট স্বপ্ন যেন বাস্তবে দেখা দেয়।
যমুনাকে দেখতে দেখতে তরুণের সারা মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
নো আংকেল, আই ওয়াজ নট এ কিডি হোয়েন ইউ স মি লাস্ট। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়তাম।
শুধু দুপুরটা বোম্বেতে কাটিয়েই আফটারনুন ফ্লাইটে যমুনাকে নিয়ে দিল্লি এলো তরুণ। পালাম থেকে সোজা গেল পুসা রোডে, যমুনার দাদুর বাড়িতে! বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নাতনীকে পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন। তরুণকে ধন্যবাদ জানালেন। ওদের ওখানেই থাকবার জন্য বার বার অনুরোধ করলেন।
কাইন্ডলি অত অনুরোধ করবেন না। আই অ্যাম কমিটেট টু স্টে উইথ এ ফ্রেন্ড অফ মাইন।
বিদায় নেবার আগে যমুনাকে বললে, দাদু-দিদিমাকে বেশি জ্বালাতন করো না। দরকার হলে আমাকে টেলিফোন করো!
তরুণ আর দেরি করল না। সোজা চলে গেল বড়ুয়ার ওখানে।
বড়ুয়া বড় পুরনো বন্ধু। বার্লিনে বসেই ওর অ্যাকসিডেন্টের খবর পেয়েছিল। শুধু উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে চিঠি লিখেছিল, আর কিছু করতে পারেনি।
বড়ুয়া একটা গার্ডেন চেয়ারে বসে লনে অপেক্ষা করছিল তরুণের জন্য। ট্যাক্সি এসে থামতেই চিৎকার করল, রানি, এসে গেছে।
রানি ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসে বলল, মাই গড! এত দেরি করলেন?
এত দেরি কোথায়? যমুনাকে নামিয়ে দিয়েই তো চলে এলাম।
তরুণ তাড়াতাড়ি গিয়ে বড়ুয়াকে জড়িয়ে ধরল। এখন কেমন আছ?
একটু একটু হাঁটা-চলা করছি।
রানি বলল, ও তো এয়ারপোর্টে যাবে বলে ভীষণ জিদ ধরেছিল…
তরুণ বলল, যেতে দাওনি তো?
আমার কথা কি শোনে? ডক্টর স্টপড় হিম গোয়িং।
পম্পি কোথায়?
বড়ুয়া বলল, এক্সকারসানে গেছে। তিন-চারদিন পর ফিরবে।
রাত্রে ডিনারের পর অনেক গল্প হলো। কলহান, মিশ্র, ট্যান্ডন, হাবিব, দেশাই ও কতজনের কথা।
অনেক কথার শেষে বড়ুয়া বলল, এখন তো তুমিই সব চাইতে ওয়াইডলি ডিসকাসড় ডিপ্লোম্যাট।
তার মানে?
রানি মাঝখান থেকে মন্তব্য করল, সত্যি দাদা, সারা মিনিস্ট্রি আপনাকে নিয়েই মেতে উঠেছে।
বড়ুয়া বলল, হ্যাটস্ অফ টু ইন্দ্রাণী। একটা বাঙালি মেয়ে দুটো গভর্নমেন্টকে নাচিয়ে দিল।