ইন্দ্রাণীর অদৃষ্টে এমনি কোনো বিপর্যয় ঘটেনি তো?
ভাবতে পারে না তরুণ।
২০. কিছু কিছু চরম মুহূর্ত
প্রতি মানুষের জীবনের কিছু কিছু চরম মুহূর্ত আসে, যখন প্রতিটি মুহূর্তের অর্থ আছে, তাৎপর্য আছে, গুরুত্ব আছে। সর্বস্তরের সব মানুষের জীবনেই এমন মুহূর্ত আসে।
তরুণের জীবনে আজ আবার তেমনি চরম মুহূর্ত হাজির।
এমন মুহূর্ত এর আগেও এসেছে। পরীক্ষার হলে কোশ্চেন পেপার পাবার আগে, রেজাল্ট বেরুবার দিন, ফরেন সার্ভিসের ইন্টারভিউ দেবার সময় হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন শুনতে পেয়েছে। কেন? ঢাকার সেই শেষ দিনগুলোতে? কিন্তু আজ যেন সুপ্রীম কোর্টের ফুল বেঞ্চের রায় বেরুবার জন্য অপেক্ষা করছে। এরপর যেন আর কোনো গতি নেই।
দেশাই-এর চিঠি পাবার পর দিনই দিল্লি থেকে একটা মেসেজ পেল তরুণ। দেশাই যে খবর দিয়েছিল, সেই খবরই পাক পররাষ্ট্র দপ্তর দিল্লিতে পাঠিয়েছে এবং তরুণ তারই কপি পেল।
সময় যেন কাটে না, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেন আরো জোরে শুনতে পায়। সে এক বিচিত্র অনুভূতি! চব্বিশ ঘণ্টা কত কি ভাবে। কত আজেবাজে চিন্তা আসে মনে। বহু মেয়েকে প্রথমে নিশ্চিন্ত আশ্রয় দিয়ে পরে পাচার করা হয়েছে লাহোরের আনারকলি বাজারের পিছনের সরু গলিতে। সেখানে তাদের নাচ শেখান হয়েছে, গান শেখান হয়েছে, শেখান হয়েছে বেলুচিস্থানের প্রাণহীন মরুভূমির হৃদয়হীন মানুষগুলোকে প্রলুব্ধ করতে। ইন্দ্রাণীর অদৃষ্টে যদি…।
মাথাটা ঘুরে ওঠে তরুণের। সারা শরীরটা ঝিম ঝিম করে উঠল। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনগুলো হঠাৎ খুব জোর হয়েই থেমে গেল!
প্রিয়জন সম্পর্কে কোনো অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা দেখা দিলেই যত খারাপ চিন্তা মনে আসে।
মনে আসবে না? সেই সর্বনাশা দিনগুলোতে কি হয়নি? সুস্থ স্বাভাবিক মানুষগুলোও যে অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। স্নায়ুগুলো যেন সেতারের তাদের মতো ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল বহুজনের মধ্যে। সুপ্ত পশু প্রবৃত্তিগুলোরই তখন রাজত্ব। মানুষগুলো ফিরে গিয়েছিল তার আদিমতম অন্ধকার দিনগুলিতে।
ইন্দ্রাণী কি এদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে? লাহোর, পেশোয়ার, রাওয়ালপিণ্ডির কোনো হারেমে তার স্থান হয়নি তো?
হয়তো হয়েছে, হয়তো হয়নি। বাঙালির জীবনের সেই চরম অন্ধকার রাত্রেও কিছু কিছু মহাপ্রাণ জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে এগিয়ে এসেছিলেন অসহায় শিশুকে আশ্রয় দিতে, বিপদগ্রস্ত যুবতীর সম্মান রক্ষা করতে, নিঃসম্বল নারীকে আশ্রয় দিতে। এগিয়ে এসেছিলেন বহু ছাত্র, শিক্ষক, অধ্যাপক। পূর্ব বাংলার এই সব মহান, মহাপ্রাণ মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে বহু হিন্দু মেয়ে সন্তানের মতো স্নেহ পেয়েছে, আপন বোনের মতো ভালোবাসা পেয়েছে, মায়ের। সম্মান পেয়েছে।
ইন্দ্রাণী কি এমনি কোনো পরিবারের একটু আশ্রয় পায়নি?
ঢাকায় কত মুসলমান পরিবারের সঙ্গেই তো ওদের ভাব, ভালোবাসা প্রীতির সম্পর্ক ছিল। ঈদের দিন কত বাড়িতে ঘুরে ঘুরে মিষ্টি খেয়েছে। অসহায়া ইন্দ্রাণীকে দেখে কি তাদের কারুর মন কেঁদে ওঠেনি? কেউ কি ওকে কোলে তুলে নেয়নি? চোখের জল মুছিয়ে দেয়নি?
নিশ্চয়ই দিয়েছে।
ভাবতে ভাবতে তরুণ যেন উন্মাদ হয়ে ওঠে। ঢাকা থেকে একটা চিঠি, করাচি থেকে হাবিবের একটা মেসেজ পাবার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে উন্মুখ হয়ে থাকে সে।
সেদিন বিকেলে হঠাৎ মনে পড়ল বন্দনার দু দুটো চিঠি এসে গেছে অথচ উত্তর দেওয়া হয়নি। ইন্দ্রাণীর চিন্তায় আর কাউকে ভাবার অবকাশ পায়নি। বন্দনাকেও না?
অ্যাপার্টমেন্টে একলা একলা বসেছিল কিন্তু মনে হল সবাই জেনে গেল বন্দনাকেও সে ভুলতে বসেছে।
ছি, ছি।
নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল। আর কিছু না হোক, ওর প্রমোশনের খবর, লন্ডনে বদলী হবার সংবাদটা অতি অবশ্যই বন্দনাকে জানান উচিত ছিল। দেশাই-এর চিঠিটার কথাই বা কেন লিখবে না?
আর দেরি করল না। বন্দনাকে সব লিখল, সব কিছু জানাল। সব শেষে লিখল, জানি
কি লিখলাম, কি জানালাম। মনের যা অবস্থা। দাদা হয়ে ছোট বোনকে এসব লেখা ঠিক হলো কিনা বুঝতে পারছি না। সে বিচার করার মানসিক অবস্থা আমার নেই। তবে বোন, তোমাকে ছাড়া আর কাকে লিখব? তুমি তো শুধু আমার বোন নয়, তুমি আমার মা, তুমি আমার বন্ধুও বটে।
আর লিখল, মনে হচ্ছে তোমাদের ওখানে যাবার পরই বিধাতা আমাকে চরম খবরটা জানাবেন। হয়তো আমার জন্য তোমাদের অদৃষ্টেও কিছু দুর্ভোগ জমা আছে। যদি সত্যিই কোনো সর্বনাশা খবর পাই, তাহলে দাদাকে আর খুঁজে পাবে না। তোমাদের দু ফোঁটা চোখের জল পড়লেই আমার আত্মার শান্তি হবে। এর চাইতে বেশি কিছু করলে আমি যে ঋণের বোঝা বইতে পারব না।
বন্দনার চিঠি আসতে দেরি হলো না। দীর্ঘ চিঠির শেষে লিখল, দাদা, তোমার কোনো অকল্যাণ হতে পারে না। আর কেউ না জানুক, আমি অন্তত জানি তুমি কি ধাতু দিয়ে তৈরি, ঔদার্যে ভরা। আমার মতো নিঃসম্বল অসহায় মেয়েকে যে চরম সর্বনাশের মুখ থেকে রক্ষা করেছে, তার অকল্যাণ করার সাহস ভগবানেরও নেই।
চিঠিটা শেষ করে আবার নিচে লিখেছিল, তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে? তুমি যেভাবেই হোক দিল্লি যাওয়া বন্ধ কর। আমার মনে হয় তোমার এখন আমার কাছেই থাকা উচিত। যত তাড়াতাড়ি পার এখানে চলে এসো।
ট্যান্ডন সাহেবও ঠিক এই কথাই ভাবছিলেন। তরুণের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ওর দিল্লি যাওয়াটা ঠিক পছন্দ করছিলেন না। ইতিমধ্যে একদিন অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে টেলিফোনে অন্যান্য কথাবার্তা বলতে বলতে এই প্রসঙ্গটাও তুলেছিলেন, স্যার, ও এখন এমন টেনসনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে যে দিল্লিতে না গেলেই ভালো হয়।