ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘনঘটা দেখা দিল। একটা আমেরিকান প্লেন ইউনাইটেড নেশন-এ ডিউটি দেবার সময় উত্তর কোরিয়ার আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেলে চীনাদের গুলি খাবার পর। আরোহী ও বিমান-চালকদের সম্পর্কে কিছু জানা গেল না। প্রায় একবছর পর খবর পাওয়া গেল এগারো জন বিমান-চালক। ও তাদের সঙ্গীরা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দীর্ঘ কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
শুরু হলো মারাত্মক স্নায়ুযুদ্ধ। আশঙ্কা দেখা দিল বিশ্বযুদ্ধের। ইউনাইটেড নেশনস্-এ ঝড় বইতে লাগল।
এমন সময় ইউ-এন কাফেতে নন্দার সঙ্গে ভদ্রলোকের দেখা।
আপনি বলেছিলেন আপনার কাছে সিটারের অনেক রেকর্ড আছে…।
হ্যাঁ, আছে।
বেশি কিছু নয়, সামান্য টেপ করার অনুমতি চাইলেন। অনুরোধটা ঠিক পছন্দ না করলেও ভদ্রতার খাতিরে না বলতে পারলেন না মিঃ নন্দা। বললেন, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। তবে কদিন একটু ব্যস্ত…।
কারেন্ট ক্রাইসিস নিয়ে ব্যস্ত বুঝি?
যাই হোক কদিন পর ভদ্রলোক সত্যি সত্যিই টেপ রেকর্ডার নিয়ে নন্দার ফিফটি সিক্স স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে হাজির হলেন। ডাইরেক্ট রেকর্ডিং চ্যানেলে টেপ রেকর্ডারটা ফিট করে খোস-গল্প শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ আজেবাজে কথাবার্তা বলার পর এলো সেই প্রশ্ন, এতবড় ক্রাইসিসে আপনারা নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নেই?
নন্দা বললো, আর সবার মতো আমরাও চিন্তিত।
দ্যাটস্ টু, বাট ইন্ডিয়ার তো একটা স্পেশ্যাল পজিশন আছে। বোথ আমেরিকা আর চীনের বন্ধু হচ্ছে একমাত্র ইন্ডিয়া।
আরো অনেক দেশ আছে।
তবুও…।
ওয়ার্লড ওয়ার হলে আমাদের এরিয়ার অনেক দেশের ক্ষতি হবে। তাই আমরা চাই ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে যাক।
ভদ্রলোক অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ইউ আর পারফেক্টলি রাইট মিস্টার নল্ডা। আমি সিওর, তোমরা চুপচাপ বসে থাকবে না। তাই না?
উদাসীন ভাবে মিঃ নন্দা উত্তর দিলেন, জানি না। আমার মতো চুনোপুঁটি ডিপ্লোম্যাট কি এসব খবর জানতে পারে?
নন্দা যে ইন্ডিয়ান মিশনের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করছিলেন, এ খবর ভদ্রলোক নিশ্চয়ই জানতেন। তা না হলে ওদের মিশনের পার্টিতে নন্দাকে এতবার করে যাবার কথা কেউ বলতো না এবং ভদ্রলোকও সীটার রেকর্ড করার জন্য ওর ফ্ল্যাটে যেতেন না।
অবস্থা আরো জটিল হল। ওয়াশিংটনের হুমকি আর পিকিংয়ের অবজ্ঞা চলল সমান তালে। তাড়াহুড়ো করে আমেরিকা ফরমোজার সঙ্গে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করল, মার্কিন নৌবহরের সেভেনথ ফ্লীট চীনের চারপাশে মহড়া দিতে শুরু করল। তবুও চীন বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে বার-বার বলল, হুশিয়ার আমেরিকা।
ডালেস-ম্যাকার্থীর মতবাদের জোর যখন কমতে শুরু করেছে ঠিক তখন এই আন্তর্জাতিক ঘন-ঘটায় আমেরিকা আবার ক্ষেপে উঠল। ভারতবর্ষ সত্যি চিন্তিত হলো। এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হবার আশঙ্কায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত বলে দুনিয়ার খবরের কাগজে খবর ছাপা হলো। অনেকেই আশা করছিলেন ইউনাইটেড নেশনস-এ ভারত কিছু করবে ও পিকিং-এর সঙ্গে দিল্লির নিশ্চয়ই কথাবার্তা হয়েছে।
মিসিসিপি-ইয়াংসী নদীর জল আরো গড়াল। ইউনাইটেড নেশনস্-এর সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যাঁমারশিন্ড গেলেন পিকিং। জানুয়ারি মাসের প্রাণান্তকর শীতের মধ্যেও হাসিমুখে চীনা নেতাদের সঙ্গে দিনের পর দিন কথাবার্তা বললেন। এক ফাঁকে ছ-মাইল দূরে দুঃসাহসিকা। মহারাণীর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সামার প্যালেস দেখলেন। এই প্যালেসের পাশে ওই সুন্দর লেকের স্বচ্ছ জলে হ্যাঁমারশীল্ড হয়তো নিজের মুখের প্রতিবিম্ব দেখার অবকাশ পাননি। যদি সে প্রতিবিম্ব দেখতে পেতেন তবে নিশ্চয়ই অন্তরের অস্থিরতা বুঝতে পারতেন। সেক্রেটারি জেনারেল শূন্য হাতেই ফিরে গেলেন ইউইয়র্ক। তবে কেউ কেউ বললেন, আশা পেয়েছেন। আমেরিকাকে আর একটু শিক্ষা দিয়ে চীনারা ওই আটক বিমানচালকদের মুক্তি দেবে।
এবার সারা পৃথিবীর দৃষ্টি পড়ল দিল্লির উপর।
ঠিক এমন সময় নন্দা বদলি হলেন আমাদের হংকং মিশনে। সীটার প্রেমিকের মতো কিছু ডিপ্লোম্যাট অনুমান করলো, স্পেশ্যাল অ্যাসাইনমেন্টে নন্দা হংকং যাচ্ছে।
সহকর্মীদের সহযোগিতায় ঘর-বাড়ি দেখে সংসার পাতার আগে নন্দা কয়েকদিনের জন্য হোটেলে আশ্রয় নিলেন। মান্দারিন বা হংকং হিলটনে থাকার মতো ট্যাকের জোর কোনো ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটেরই নেই। নন্দারও ছিল না। তাই তো তিনি আশ্রয় নিলেন উইনার হাউসে।
পর পর কদিন রাত্রে ডিনার খাবার সময় পাশের টেবিলে এক ভদ্রলোককে দেখেই নন্দার সন্দেহ হলো। পরে ইন্ডিয়ান মিশনের এক সহকর্মীর সঙ্গে কান্ লিঙ ক্যাস্টনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়েও এক কোণায় ডাইনিং হলের ওই ভদ্রলোককে দেখলেন। আবার একদিন উইনধাম স্ট্রিটে। মার্কেটিং করার সময় মহাপ্রভুর পুনদর্শন হওয়ায় নন্দার আর সন্দেহ রইল না।
নন্দা সতর্ক হয়ে গেলেও বুঝতে দিল না। মিশনের দু একজনকে ঘটনাটা জানিয়ে রাখল। তারপর একদিন ডিনার টেবিলে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো।
তোমাদের ইন্ডিয়ার মতো চার্মিং ও ফ্রি সোসাইটির কোনো তুলনা হয় না।
মেনী থ্যাঙ্কস্ ফর দি কমপ্লিমেন্টস্।
সত্যি বলছি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড চালাতে গিয়ে কত দেশই ঘুরলাম কিন্তু ইন্ডিয়া ইজ ইন্ডিয়া।
চিকেন-ফ্রায়েড রাইস আর পোর্ক শেষ করে কফির পেয়ালায় হাত দিতেই রাজনীতি এসে গেল।