পাকিস্তান ফরেন সেক্রেটারি বললেন, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ পজিশন খুব খারাপ। কোরিয়ার যুদ্ধ থেমে যাবার পর আমাদের পাটের বাজারও খুব খারাপ। ফরেন এক্সচেঞ্জের। অভাবে আমরা প্রয়োজনীয় ফুড গ্রেনস্ ও ইন্ডাস্ট্রির জরুরি ইমপোর্টস পর্যন্ত করতে পারছি। না! সুতরাং ন্যাটো আর্মস কিনব আমরা? ইট উড বি এ বিবলিক্যাল ড্রিম ফর আস!
ফরেন সেক্রেটারি ইন্ডিয়ান হাই-কমিশনারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টা করে বললেন, অনেক কষ্টে দু দেশে রিলেসান্স একটু ইমপ্রুভ করেছে। এখন আর কিছু না হোক আমি আমার লক্ষৌর পুরনো বাড়িতে যেতে পারি, বুড়ী নানীর সঙ্গে দেখা করতে পারি, শালীর একটু ওয়ার্ম কোম্পানি পেতে পারি। ডু ইউ থিংক আমরা এমন কাজ করব যাতে এই সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে যায়।
আমরাও তো তা আশা করি না!
ফরেন সেক্রেটারি শেষে বললেন, ভুলে যাবেন না উই আর সেয়ারিং সেম হিউম্যান মিজারিজ! ওই যে ইন্দ্রাণীর কেসটা আপনারা রেফার করেছেন…
হ্যাঁ, হ্যাঁ…
ভাবুন তো কি ট্রাজেডি!…আই অ্যাম প্যার্সোন্যালী লুকিং ইনটু দ্য ম্যাটার এবং আশা করি দু এক মাসের মধ্যেই মেয়েটিকে খুঁজে বার করা যাবে।
উই উইল বী গ্রেটফুল…
গ্রেটফুল হবার দরকার নেই। তবে দেখবেন যেন ওদের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে পারি।
হাসতে হাসতে হাই-কমিশনার বললেন, আমি নিজে এসে আপনাকে নেমন্তন্ন করে যাব।
মাসখানেক তীব্র উত্তেজনার মধ্যে কাটাবার পর দিল্লি থেকে পাকিস্তানী ফরেন সেক্রেটারির মন্তব্যের রিপোর্ট পেয়ে দীর্ঘদিনের ক্লান্তি এক মুহূর্তে বিদায় নিল। অনেক দিন পর আবার ইন্দ্রাণীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করল তরুণ।
দিন তিন-চার পরেই মিঃ ট্যান্ডন তরুণকে ডেকে পাঠালেন।
বসো তরুণ।
কি ব্যাপার।
দেয়ার ইজ এ গুড পিস অফ নিউজ ফর ইউ।
চমকে উঠল তরুণ। তবে কি ইন্দ্রাণীর কোনো খবর পাওয়া গেছে? তরুণ মুখে কিছু বলল, উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইল ট্যান্ডন সাহেবের মুখের দিকে।
প্রথম কথা, তুমি প্রমোশন পাচ্ছ…
তরুণ শুধু একটু হাসল।
দ্বিতীয় কথা, তোমার ট্রান্সফার হচ্ছে।
কোথায়?
বোধহয় লন্ডনে।
তরুণ হেসে ফেলল। লন্ডনে? মনে হয় তাই।
তারপর ধীরে ধীরে মিঃ ট্যান্ডন জানালেন, ন্যাটো আর্মস সেল নিয়ে যা হয়ে গেল, তার জন্য মিনিস্ট্রি মনে করে তোমাকে আর বার্লিনে রাখা ঠিক নয়।
সেটা আমিও ফিল করছিলাম।
অ্যাম্বাসেডর যা বললেন তাতে মনে হয় তোমাকে ফার্স্ট সেক্রেটারি, পলিটিক্যাল করে লন্ডনেই পাঠান হবে। তবে…
তবে কি?
হয়তো ইন-বিটুইন দু এক মাসের জন্য দিল্লিতে যেতে হতে পারে।
শালগ্রাম শিলার আর শোওয়া-বসা? স্ত্রীর অমত, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার সমস্যা যখন নেই, তখন লন্ডন আর দিল্লি। সবই সমান।
প্রমোশন? কৃতিত্বে, উন্নতিতে আর পাঁচজন খুশি হয় বলেই আনন্দ। কিন্তু তরুণ কাকে খুশি করবে? হ্যাঁ, বন্দনা-বিকাশ নিশ্চয়ই খুশি হবে, কিন্তু…
ওই কিন্তুটা তরুণের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওর থেকে মুক্তি নেই।
দু একদিন পরেই ঢাকা থেকে দেশাই-এর একটা চিঠি পেল, ঠিক বুঝতে পারছি না কি ব্যাপার। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ইন্দ্রাণীকে খুঁজে বের করার জন্য হঠাৎ অত্যন্ত বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। মনে হয় করাচি থেকে চাপ এসেছে।
ওই চিঠিটা ওইখানেই শেষ। তবে সঙ্গে আরেকটা স্লিপ। তাতে লিখেছে, আজ অফিসে এসেই খবর পেলাম যে রায়টে ইন্দ্রাণীর বাবা-মা মারা যান। আগে বাড়িতে যখন আগুন। লেগেছিল তখন চাপা পড়ে ছোটভাই মারা যায়। এর পর ইন্দ্রাণীকে স্থানীয় এক মুসলমান পরিবার আশ্রয় দেন।
দেশাই শেষে লিখেছে, ইস্ট পাকিস্তানের ডি-আই-জি (সি-আই-ডি) নিজে কেসটা ডিল করছেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই আরো খবর জানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
চিঠিটা বার বার পড়ল। দশবার-বিশবার পড়ল। একটা চাপা উত্তেজনায় প্রায় ফেটে পড়ল তরুণ। চিঠিটা নিয়ে প্রায় দৌড়ে গেল মিঃ ট্যান্ডনের ঘরে।
ট্যান্ডন সাহেবও চিঠিটা বার কয়েক পড়লেন। হেসে বললেন, সত্যি সুখবর।
একটু পরে বললেন, পাকিস্তান ওদের অনেস্ট ইনটেনশন প্রমাণ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।
নিজের ঘরে ফিরে এসেই তরুণ দেশাইকে কেবল পাঠাল, থ্যাঙ্ক ইওর কাইন্ড লেটার স্টপ অ্যাংসাসলি এক্সপেটিং ফারদার ডেভলপমেন্ট স্টপ লাভ টরুণ।
আশা-নিরাশার দোলায় তরুণ প্রায় পাগল হয়ে উঠল। দেশটা দু টুকরো হবার পর পূর্ব বাংলার বহু হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলমানদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ে হয়েছে নানা কারণে। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়। তাদের কেউ সুখী, কেউ অসুখী।
এমন অনেক মেয়ের কথা তরুণ জানে। শাঁখা-সিঁদুর পরেও অনেক হিন্দু মেয়ে মুসলমান স্বামীর ঘর করছে, তাও সে জানে।
দিল্লিতে থাকতে এমন অনেক কেস সে নিজে ডিল করেছে। নাটক-নভেলকে হার মানাবে সে-সব কাহিনি। গুণ্ডা-দস্যুদের হাত থেকে হিন্দু মেয়েদের বাঁচাবার জন্য সারা পূর্ব বাংলার বহু মুসলমান পরিবার তাদের ঠাই দিয়েছেন নিজেদের পরিবারে। অনেক প্রগতিশীল যুবক হিন্দু। মেয়েদের ধর্মান্তরকরণ না করিয়েই বিয়ে করেছে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের দপ্তরে গিয়ে।
বাঙালির জীবনের সেই ঘন দুর্যোগের রাত্রিতে আরো কত কি হয়েছে। কেউ কেউটে সাপের মতো ছোবল দিয়েছে, আবার কেউ পশুরাজ সিংহের মতো ঔদার্য দেখিয়ে হাতের কাছের শিকার ছেড়ে দিয়েছে।