বন্দনা ছাড়া আর কে এত আপন-জ্ঞানে বলতে পারে, দাদা, তুমি আমার শাড়ির নিচের কুঁচিগুলো চেপে ধরো তো; আমি কাপড়টা ঠিক করে পরে নিই।
কোনো কোনোদিন পার্টিতে যাবার সময় বিচিত্র হেয়ার-ডু করে দুহাত দিয়ে খোঁপাটা চেপে ধরে ডাকত, দাদা একটু এ ঘরে এসো।
কেন, কি হলো?
তরুণ ঘরে এলে বলত, ওই সামনের কাঁটাগুলো দিয়ে দাও তো।
কাঁটাগুলো খোঁপায় গুঁজে দিতে দিতে তরুণ বলত, কি দরকার এত সব কায়দা-টায়দা করার?
জীবনে কোনোদিন ঠিক আনন্দ করার অবকাশ পেলাম না তো, তাই তোমার এখানে এসেও লাইফটাকে এঞ্জয় করব না?
কে এমন স্পষ্টভাবে দাবি জানাতে পারে?
বন্দনা সত্যি অনন্যা!
বন্দনাকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসে বড় বিশ্রী লাগছিল। চুপচাপ কৌচটায় বসে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের কয়েকটা দিন আরো খারাপ লাগল। নিঃসঙ্গতার জ্বালাটা বড় বেশি অনুভব করল।
অফিসে যাতায়াত করে, কিন্তু কাজকর্মে মন দিতে পারে না। ট্যান্ডন সাহেব সবই বোঝেন কিন্তু কিছুই বলতে পারেন না।
আরও কিছুদিন কেটে গেল। জীবনটা যেন আরো বিবর্ণ হয়ে গেল। দিল্লি, লন্ডন, নিউইয়র্কে তবু সময় কেটে যায়, কিন্তু বার্লিনে যেন সময় কাটতে চায় না। একদিন কথায় কথায় ট্যান্ডন সাহেবকে বলেই ফেলল, আর এখানে ভালো লাগছে না। ভাবছি এবার ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করি।
যেখানে ট্রান্সফার হবে, সেখানে গিয়ে ভালো লাগবে?
তরুণ আর জবাব দিতে পারেনি।
মিঃ ট্যান্ডনই আবার বললেন, তুমি ট্রান্সফার চাইলে নিশ্চয়ই মিনিস্ট্রি আপত্তি করবে না, তবে তাতে তোমার কি লাভ? বরং ওয়েট ফর সাম টাইম।
কাজকর্মের চাপ না থাকায় তরুণের আরো খারাপ লাগছিল। নিউইয়র্ক, লন্ডন, মস্কো, পিকিং-এ ডিপ্লোম্যাটদের মধ্যে যে চাপা উত্তেজনা থাকে, বার্লিনে তাও নেই। কি নিয়ে থাকবে তরুণ?
মাস খানেক পরে দু তিনজন জেনারেল অ্যাসিস্ট্যান্ড কাম স্টেনো টাইপিস্টের ইন্টারভিউ নিচ্ছিল তরুণ। পাঁচ-ছটি মেয়ে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল।
মিস হেরম্যানের ইন্টারভিউ নেবার সময় তরুণ জানতে চাইল, এর আগে কোথাও কাজ করেছেন?
কয়েক মাস আগেই ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি। ঠিক চাকরি করিনি কোথাও।
তবে কি করেছেন?
এল-বির পাড়ে নর্থল্যান্ড স্যানাটোরিয়ামে একজন পাকিস্তানী অফিসারের কাছে মাঝে মাঝে কাজ করেছি।
তরুণ ন্যাকামি করে প্রশ্ন করল, ইজ হি এ বিজনেসম্যান?
না, না, বিজনেসম্যান না। পারহ্যাপস হি ইজ অ্যান আর্মি অফিসার।
আপনি জানলেন কি করে?
উনি যে কেবল রাওলপিন্ডি আর পেশোয়ারে আর্মি অফিসারদেরই চিঠি লেখেন।
তরুণ আর এগোয়নি। বুঝেছিল, অফিসারটি অসুস্থ নয়; কারণ চিকিৎসার জন্য স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি হলে নিশ্চয়ই এত চিঠিপত্র লেখালেখি বা কাজকর্ম করতেন না। ওটা নিশ্চয়ই একটা কভার। গোপনে কাজ করার কায়দা মাত্র।
মিস হেরম্যানের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার টাইপ হবার আগেই বন-এর ইন্ডিয়ান এম্বাসিতে মেসেজ চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বন থেকে দিল্লি; দিল্লি থেকে করাচি।
দিন দুয়েকের মধ্যেই বার্লিনে খবর এসে গেল। …কয়েকদিন আগে করাচিতে পাকিস্তান-কানাডার চুক্তি হলো যে দু বছর অন্তর দু দেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির ডেলিগেশন এক্সচেঞ্জ হবে। ডিফেন্স মিনিস্ট্রির যে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এই ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তিনি এবার এ স্বাক্ষর করেননি। শোনা যাচ্ছে উনি অসুস্থ এবং চিকিৎসার জন্য জেনেভা গেছেন।
পাকিস্তান অবজার্ভার, ডন, পাকিস্তান টাইমস ও আরো বহু পত্রিকায় নানা চুক্তি সই করার পর ওই অ্যাডিশনাল সেক্রেটারির ছবি ছাপা হতো। খবরের সঙ্গে এইসব ছবির কয়েকটা কপিও দিল্লি থেকে বার্লিনে পাঠানো হলো।
একটু কায়দা করে মিস হেরম্যানকে ছবিগুলি দেখাতেই সে বলে উঠল, এই ভদ্রলোকের কাছেই সে কাজ করেছে।
ইতিমধ্যে রোমের একটি পত্রিকায় খবর বেরুল, ইতালি পুরনো ন্যাটো আর্মস বিক্রির জন্য মিডল ইস্ট ও ফার ইস্টের কয়েকটি দেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে।
এক সপ্তাহের মধ্যেই কানাডা, পশ্চিম জার্মানি ও পর্তুগালের কয়েকটি পত্রিকায় অনুরূপ খবর বেরুল।
ঠিক এই পটভূমিকায় পাকিস্তান ডিফেন্স মিনিস্ট্রির অ্যাডিশনাল সেক্রেটারির বার্লিন উপস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের কষ্ট হলো না। দিল্লি আরো তৎপর হলো।
মেসেজ চলে গেল চারদিকে। ওয়াশিংটন, লন্ডন, বন, বোম, প্যারিস ও আরো কয়েকটি ন্যাটো কান্ট্রিতে। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরা সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ওই সব দেশের ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গে। কোনো কোনো দেশ ন্যাকামি করে বলল, উই হ্যাড নো ইউফরমেশন অ্যাবাউট সেল অফ ন্যাটো আর্মস।
ওয়াশিংটন থেকে বলা হলো, ন্যাটো আর্মস নিয়মিত আধুনিকীকরণ করা হয়। ইট ইজ এ রেগুলার প্রসেস। বাট ওই আর্মস অন্য দেশে বিক্রি করতে হলে আমাদের পারমিশন চাই। সুতরাং ডোন্ট ওরি!
ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরকে তারা একথাও বললেন, উই উইল থিংক টোয়াইস বিফোর উই অথোরাইজ এনি সাচ সেল টু পাকিস্তান।
সব শেষে করাচি। ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার পাকিস্তান ফরেন সেক্রেটারিকে বললেন, আপনারা আমস নিলে আমাদের দুই দেশের রিলেসানস অ্যাফেক্ট করতে বাধ্য।