বন্দনার কথা শুনে দুজনেই হাসল।
বেশ কাটছিল দিনগুলো। এর আগে মহাশূন্যতার মধ্যে তরুণ ভেসে বেড়াত। আজকাল? সব শূন্যতা যেন পূর্ণ করেছে বন্দনা। একটি মুহূর্তের জন্যও তরুণ নিঃসঙ্গতার বেদনা অনুভব করতে পারে না।
তরুণের মুখটা তুলে ধরে বন্দনা বলল, তুমি চুপটি করে কি ভাবছ দাদা? আমি রান্না করছি, চলো না, তুমি ওখানে গিয়ে বসবে।
তরুণ আর চুপটি করে একলা বসতে পারে না। বন্দনা রান্না করে আর ও পাশে ইজিপসিয়ান মোড়াটা নিয়ে বসে বসে গল্প করে।
আচ্ছা দাদা, তুমি রান্নাঘরে গিয়ে মাসিমার সঙ্গে গল্প করতে?
খুব ছেলেবেলায় মার পাশে পাশেই কাটাতাম কিন্তু বড় হবার পর আর সে সুযোগ পেতাম না।
কেন?
ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তরুণ হাসল। পুরনো দিনের কথা মনে হতেই কোথায় যেন তলিয়ে গেল।
উদাস ফ্যাকাশে দৃষ্টিটা বাইরের দিকে ফিরিয়ে তরুণ বলল, পরের দিকে ইন্দ্রাণী না হলে মার এক মুহূর্তও চলত না। ইন্দ্রাণীকে কাছে পেলেই মার ফিসফিস শুরু হয়ে যেতো।
মাসিমা ওকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আপন মনেই বন্দনা বলল।
কথা বলতে বলতেই মাছ ভাজা হয়ে গেল। একটা মাছ ভাঙা প্লেটে তুলে তরুণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নাও দাদা।
সে কি? এখন মাছ খাব কেন?
আমি দিচ্ছি, খেয়ে নাও না।
আরো এগিয়ে চলে। তরুণ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার দুটো টিকিট কিনে এনেছে। বন্দনাকে বলেছে একটু ভালো কাপড়-চোপড় পরে যেতে। ভিতরের ঘরে সাজগোজ করছে সে। তরুণ সিগারেট খেতে খেতে পায়চারি করছে।
দাদা, একটু এদিকে আসবে?
কি হলো?
একটু এসো।
ও-ঘরে গিয়ে বন্দনাকে দেখেই তরুণ বলল, বাপরে বাপ! বার্লিনার্সরা ভাববে ইন্ডিয়ান কুইন এসেছে।
আমি কুইন না হতে পারি বাট সিস্টার অফ অ্যান ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাট!
ঠোঁটটা উন্টে তরুণ বলে, এই গহনা-টহনা কাপড়-চোপড় দেখে, কি বিশ্বাস করবে?
বন্দনাকে দেখতে ভালোই। চোখ-মুখ বেশ শার্প। নাকটা যেন একটু চাপা। তবে তা নজরে পড়ে না। চেহারার গড়নটাও বেশ ভালো। লন্ডনের একদল ইন্ডিয়ান ছোঁকরা যে বন্দনার সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য টি বোর্ডের দোকানে আড্ডা জমাত, সেজন্য ওদের দোষ দেওয়া যায় না। আজ আবার একটা কালো বেনারসী পরেছে। আই-ল্যাশ দিয়ে চোখ দুটোকে আরো সুন্দর করেছে। পেন্ট করেনি বটে তবে একটু বিউটি ট্রিটমেন্ট করায় সুন্দর মুখটা আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।
দাদা, এই দুলটা পরিয়ে দাও তো। দুল দুটো এগিয়ে দিয়ে বলল, এমন বিশ্রী ডিজাইন যে পরাই একটা ঝামেলা।
এই মাটি করেছে। আমি কি পারব?
পারব না বললে কি বন্দনা ছাড়ে!
বন্দনাকে কাছে পেয়ে নতুন করে বাঁচার আশা পায় তরুণ। আনন্দ পায়, উৎসাহ পায়। জীবনযাত্রার ধরনটাও পাল্টে গেল। কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়েই দিন কাটে না। প্রতিদিন কত কি রান্না করে বন্দনা।
এত কি খাওয়া যায়?
তুমি বড্ড বেশি তর্ক কর, দাদা। অন্তত খাওয়া-দাওয়ার ভারটা আমাকে ছেড়ে দাও।
তরুণ আর তর্ক করে না। হার স্বীকার করেও যেন জিতে যায়।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে গল্প করত কত রাত পর্যন্ত। ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে কত কথা হতো।
চল, এবার তুমি শুতে চল।
তরুণ বুঝত এ অনুরোধ নয়, অর্ডার। এই তো যাচ্ছি।
আর এই তো যাচ্ছি নয়, এবার ওঠ।
তরুণ উঠে পড়ে। বন্দনা আগেই বিছানাপত্র ঠিক করে রেখেছে। তরুণ শুতে না শুতেই বন্দনা ব্ল্যাঙ্কেট ঠিক করে দেয়!
আমি কি বাচ্চা? কম্বল-টম্বলও গায়ে দিতে পারি না?
এত আদরে মানুষ হয়েছ যে এসব শেখার সুযোগ পেলে কোথায়?
বন্দনা ভোরবেলায় উঠে পড়ে। একবার উঁকি দিয়ে তরুণকে দেখে নেয়। হয়তো কম্বলটা একটু টেনে দেয়। মুহূর্তের জন্য একটু যা ভালো করে দেখে নেয়।
দুঃখে-কষ্টে মানুষ হয়েছে বন্দনা। ঝড়-বৃষ্টি বড় বেশি সহ্য করতে হয়েছে। তরুণের স্নেহচ্ছায়ায় এসেই প্রথম একটু পরিষ্কার আকাশ দেখার সুযোগ পেয়েছে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই এই মুখোনা দেখে যেন সে অনুপ্রেরণা পায়, আনন্দ পায়। দাদার ওপর আধিপত্য করে আত্মতৃপ্তি পায় মনে মনে।
সুখের দিনগুলো আবার ঝড়ের বেগে উড়ে যায়। বন্দনার বার্লিন বাসের পালা প্রায় শেষ হয়ে আসে।
সব অভ্যেসগুলো তো নষ্ট হয়ে গেছে। এবার যে কিভাবে একলা থাকব আর স্যান্ডউইচ খাব, তাই ভাবছি।
সেইদিন দুপুরেই বন্দনা বিকাশকে লিখল, দাদাকে ছেড়ে যেতে মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। তুমি যদি রাগ না কর তাহলে আরো সপ্তাহ দুই থাকতাম।
বিকাশের উত্তর আসতে দেরি হল না। তুমি নিশ্চয়ই আরো কিছুদিন থাকবে। দাদাকে দেখলে কি আমি রাগ করতে পারি? ভুলে যেও না ওঁর চাইতে আমাদের আপন আর কেউ নেই।
পরের দিন সকালে অফিস বেরুবার সময় তরুণ বলল, আজ তোমার টিকিট কাটতে দেব।
না না, দাদা। আমার টিকিট কাটতে হবে না। তোমাকে আর একটু জ্বালাতন করি।
সে কি? বিকাশ আর কতদিন হাত পুড়িয়ে খাবে?
ওই আমাকে থাকতে বলেছে।
একটু শুকনো হাসি হাসল তরুণ। আমার সঙ্গে তোমরা এত জড়িয়ে পড়ো না। তাহলে আমার পাপে তোমাদেরও দুঃখ পেতে হবে।
সে সব তোমার ভাবতে হবে না।
১৯. বন্দনা চলে গেল
বন্দনা চলে গেল। নিয়ে গেল কিছু অনুভূতি, রেখে গেল কিছু স্মৃতি।
বিন্দুতে যেমন সিন্ধু হয়, তেমন প্রতিটি মুহূর্তের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ে জন্ম নিয়েছিল কিছু অনুভূতি। সে অনুভূতি এর আগে কোনোদিন বোঝেনি। আর রেখে গেল যে টুকরো টুকরো স্মৃতি তা তরুণের জীবনের অনন্য সম্পদ। এত বড় দুনিয়াটায় এতদিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এমন আপন করে আর কাউকে কাছে পায়নি। ভালোবাসা পেয়েছে, সমবেদনা পেয়েছে। বহুজনের কাছে। বন্দনা ইন্দ্রাণীর অভাব মেটাতে পারেনি, পারবে না, পারতে পারে না। তবুও সে যা দিয়ে গেল, তা তরুণ আর কোথাও আশা করতে পারে না।