চুপ করে থাক।
এবার বিকাশ বলে, একি করছেন দাদা?
আর একি করছেন! মাস কয়েক আগে সেটটা দেখেই ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তারপর ওদের আসার খবর পাবার পরই নোয়েলকে দাম-টাম মিটিয়ে দিয়ে গেছে।
তরুণের সঙ্গে তর্ক করার সাহস ওদের কারুরই নেই। তবুও বার বার আপত্তি করেছি।
শেষকালে আর সহ্য করতে না পেরে তরুণ বলেছিল, জীবনে কাউকেই তো কিছু দেবার সৌভাগ্য হলো না। লোকেরা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্রকে কত কি দেয়! তোমরা না হয় আমাকে সেই সৌভাগ্যটুকু উপভোগের প্রথম সুযোগ দাও।
বন্দনা-বিকাশের মুখ দিয়ে আর একটি কথা বেরোয়নি।
কিছুক্ষণ পরে তরুণ আবার বলল, দাদার কাছে ছোট ভাইবোনেরা কত কি আবদার করে। কই, তোমরা তো আমার কাছে কিছুই আবদার করলে না?
এই দুনিয়ায় স্নেহ, ভালোবাসা পাবার সৌভাগ্য চাই। কিন্তু সেই স্নেহ-ভালোবাসা অপরকে দিতে পারার মতো দুর্ভাগ্য নেই। মানুষকে ভালোবেসেই মানুষের স্বার্থকতা, পূর্ণতা, পরিতৃপ্তি। তরুণের জীবনে সেই পূর্ণতা, পরিতৃপ্তি হলো না। একথা বন্দনা-বিকাশ জানত কিন্তু সেদিন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকল। খানিকক্ষণ পরে বন্দনা বলল, এই একমাস আমি এমন জ্বালাতন করব যে তোমার আর দুঃখ থাকবে না দাদা।
বিষণ্ণ তরুণের মুখে শুকনো হাসির রেখা ফুটে উঠল। শুধু এই একমাস তো জ্বালাতন করবে, তারপর তো নয়।
পরের দিন বিকাশকে সি-অফ করতে গিয়ে তরুণের মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। বন্দনা, তুমিও চলে গেলে পারতে। ও বেচারির একলা থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে।
তোমাকে একলা ফেলে গেলে তোমার বুঝি কষ্ট হবে না?
বিকাশও সঙ্গে সঙ্গে বলল, না না দাদা, আমার কিছু কষ্ট হবে না। তাছাড়া বন্দনাও তো কতদিন ধরে একঘেয়ে জীবন কাটাচ্ছিল।
বিকাশ চলে গেল। বন্দনাকে নিয়ে তরুণ ফিরে গেল হান্স কোয়ার্টারের অ্যাপার্টমেন্টে।
একটা অ্যালুমিনিয়াম ডেক-চেয়ার নিয়ে তরুণ দক্ষিণের বারান্দায় বসল। বন্দনা চলে গেল ভিতরে।
কিছুক্ষণ পরে দু হাতে দু কাপ কফি নিয়ে বন্দনা এলো বারান্দায়।
হাসতে হাসতে তরুণ জিজ্ঞাসা করল, কি, কফি?
হ্যাঁ।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। আর একটা বসবার কিছু আনি।
তুমি ধর। আমি আনছি।
না না, আমিই আনছি।
তরুণ চট করে ভিতর থেকে একটা ইজিপসিয়ান মোড়া আনল।
কফির কাপে চুমুক দিয়েই বন্দনা বলল, একটা মাস বেশ মজায় কাটানো যাবে, তাই না দাদা?
হ্যাঁ, তা বেশ কাটবে। খুশিভরা হাসি হাসি মুখে তরুণ জবাব দেয়।
জান দাদা, আমার ভাগ্যটা যে এমন করে পাল্টে যাবে তা কোনোদিন ভাবিনি।
আত্মস্মৃতির সবগুলি অধ্যায় মনে মনে পর্যালোচনা করে বন্দনা যেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল।
এর মধ্যে আবার ভাগ্য পাল্টাল কোথায়?
ভ্রূ দুটো তুলে চোখ ঘুরিয়ে বন্দনা বলে, ভাগ্য না হলে তোমার মতো দাদা পাই? হালা কোয়ার্টারে থাকতে…
তরুণ আর হাসি চাপতে পারল না। হাসতে হাসতেই বলল, একটা আস্ত পাগলী না হলে কেউ একথা বলে?
হঠাৎ ডোর-বেলটা বেজে উঠল।
তরুণ উঠতে গেলেই বন্দনা বলল, তুমি বসো, আমি দেখছি।
বন্দনা দরজা খুলেই আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠল, আপ আ গিয়া! আইয়ে আইয়ে! তাড়াতাড়ি তরুণ উঠে গিয়ে দেখল ট্যান্ডন সাহেব এসেছেন।
ট্যান্ডন সাহেব মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, আই ওয়ানটেড টু চেক আপ দুই ভাই-বোনে কেমন মজা করছ?
বন্দনা মজা করে বলে, এই তো সবে এক কাপ কফি নিয়ে শুরু করেছি। কদিন অপেক্ষা করুন-তারপর দেখবেন।
ট্যান্ডন সাহেব বন্দনার কাঁধে হাত দিয়ে একটু কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, এই বুড়ো দাদাকেও একটু শেয়ার-টেয়ার দিও।
তরুণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল। এবার বলে, আগে তো বসুন তারপর ভাগাভাগি করা যাবে।
তরুণ আর ট্যান্ডন সাহেব লিভিং রুমের কোণার কৌচে বসলেন। পাকা গিন্নীর মতো বন্দনা জানতে চাইল, হোয়াট উইল ইউ হ্যাভ টি অর কফি?
শুধু টি অর কফি? আর কিছু খাওয়াবে না?
আপনার মতো সিনিয়র ডিপ্লোম্যাটের তো অধৈর্য হওয়া চলে না। ইউ সুড ওয়েট অ্যান্ড সী।
বন্দনার শাসন করার কায়দা দেখে দু জনেই হাসলেন।
ট্যান্ডন সাহেব কপালে হাত দিয়ে বললেন, খোদা হাফিজ! এ তো দারুণ মেয়ে। এবার তরুণের দিকে তাকিয়ে বললেন, সি সুড হ্যাভ বিন ইন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিস।
ইউ গো অন পন্ডারিং, আমি যাচ্ছি।
কার্ডিগানের হাত গোটাতে গোটাতে বন্দনা পা বাড়াল প্যান্ট্রির দিকে। ট্যান্ডন সাহেব প্রায় চিৎকার করে বললেন, তরুণ, আউটস্ট্যান্ডিং ডিপ্লোম্যাটদের মতো সি ক্যান ইগনোর টু!
তরুণ কিছুই জবাব দেয় না কিন্তু মনে মনে যেন বন্দনার জন্য গর্ব অনুভব করে।
ট্যান্ডন সাহেব এবার বলেন, ভারি চমৎকার মেয়ে! দেখলেই যেন আদর করতে ইচ্ছা করে।
সত্যি, বন্দনা খুব ভালো মেয়ে।
তুমি খুব লাকী।
অ্যাজ ফার অ্যাজ বন্দনাজ কনসার্নড়, আমি নিশ্চয়ই লাকি।
ট্যান্ডন সাহেব হঠাৎ একটু হাসলেন, অ্যান্ড সী ইজ ভেরি প্রাউড অফ ইউ।
তাই নাকি? হাসতে হাসতে তরুণ পাল্টা প্রশ্ন করে।
কিছুক্ষণ পরে বন্দনা ট্রলি-ট্রে নিয়ে হাজির হলো। প্লেট ভর্তি পাকোড়া আর কফি ছাড়াও আরো কি কি যেন।
ট্যান্ডন সাহেব ঠাট্টা করে বললেন, এত বেলায় পাকোড়া-কফি? ভেবেছিলাম লাঞ্চ খাওয়াবে।
আজকে আমাদের একটু স্পেশাল খাওয়া-দাওয়া আছে। সো ইউ মাস্ট এক্সকিউজ।