বাহাদুর শার পর বিহারীলালই দিল্লির সর্বময় অধীশ্বর হয়েছেন। তার এই প্রশংসায় জেনারেল সেক্রেটারি মিসেস খাতুন পর্যন্ত গলে গেলেন, হ জী, এহি লেড়কী আকেলা সব কুছ…
সেই হলো শুরু। শেষ? সেকথা তরুণ মিত্র জানে না। যে দেশে বাঈজীবাড়ি আর ধর্মশালা প্রায় সমান সমান, সে দেশের পবিত্র মাটিতে মিস ভরদ্বাজের কাহিনির যে কোথায় শেষ তা সে জানে না। ডিপ্লোম্যাট তরুণ মনে মনে ভাবে ডিপ্লোম্যাসী রপ্ত করবার জন্য পয়সা খরচা করে জেনেভায় যাবার কোনো অর্থ হয়? দেশের অসংখ্য মেয়েগুলোর সর্বনাশ করেও যারা দেশনেতা বলে পূজ্য, বেবী ফুডে ভেজাল দেবার পরও যাঁরা ধর্মশালা গড়ে হাততালি আদায় করতে পারেন, তাদের চাইতে বড় ডিপ্লোম্যাট আর কোনো দেশে পাওয়া সম্ভব!
০২. ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ
ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ পর্তুগালে আইন আছে, রাজধানী লিসবনে সবাইকে জুতো পরতে হবে। পয়সা কোথায়? লিসবনে হাজার হাজার মানুষের জুতো কেনার সামর্থ্য নেই। তবুও জুতোর মতোই একটা কিছু পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই হতভাগ্য মানুষের দল। দূর থেকে পুলিশ দেখলেই পরে নেবে। আবার পুলিশ একটু দূরে চলে গেলেই খুলে পকেটে রেখে দেয়।
চোখ মেলে চারদিক দেখলেই এসব দেখা যায়, জানা যায়। টুরিস্টদের মতো শুধু বাহ্যিক চোখের দেখাই ডিপ্লোম্যাটদের কাজ নয়। আরো অনেক কিছু দেখতে হয়, জানতে হয় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। দশটা-পাঁচটার চাকরি করলে ডেপুটি সেক্রেটারি দায়িত্ব শেষ হয়, কিন্তু কেনসিংটনে বা ফিফথ অ্যাভিনিউতে ককটেল পার্টিতে গিয়ে ছ পেগ আট পেগ হুইস্কি খাবার পরও ডিপ্লোম্যাটকে সতর্ক থাকতে হয় গোপনে খবর জানার জন্য। হাজার হোক ডিপ্লোম্যাটরা মর্যাদাসম্পন্ন ও স্বীকৃত গুপ্তচর ছাড়া আর কিছুই নয়। ফ্রেন্ডশিপ, আন্ডারস্টাডিং শুধু বকুনি মাত্র। ক্লোজ কালচারাল টাইস তেল দিয়ে খবর জোগাড় করার কায়দা মাত্র। অন্যান্য দেশের মতিগতি বুঝে নিজের দেশের সুবিধা করে দেওয়া অর্থাৎ স্বার্থরক্ষাই ডিপ্লোম্যাসির একমাত্র ধর্ম। এসব কথা সারা পৃথিবীর সমস্ত ডিপ্লোম্যাটরা জানেন। ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটরাও জানেন।
সব জেনেশুনেও চলেছে এই লুকোচুরি খেলা। এক-এক দেশে এক-এক রকমের লুকোচুরি খেলা চলে। মস্কো বা ওয়াশিংটনের যে কোনো ডিপ্লোম্যাটিক মিশনে যান। দেখবেন, কেউ কোনো ঘরে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন না। বাইরে বরফ পড়ছে, তবু পরোয়া নেই। ভেতরের গার্ডেনেই কথাবার্তা হবে। কেন? কেন আবার, জুজুর ভয়। কোথা দিয়ে কে সব কিছু টেপ রেকর্ড করে নেয়। আজকাল তো পয়সা দিলেই ওয়াচ রেকর্ডার পাওয়া যায়। ডিপ্লোম্যাটদের পিছনে টিকটিকি ঘোরাঘুরি করেই। টেলিফোনে কথাবার্তা নিরাপদ নয়। বড় বড় দেশের অনেক সামর্থ্য, কত কিছুই তারা করতে পারে। কিন্তু ওই ছোট্ট দেশ আফগানিস্থান! এমনই জুজুর ভয় যে কাবুলে সব ডিপ্লোম্যাটকেই টেলিফোনের প্লাগ খুলে রাখতে দেখা যাবে।
আরো কত কি আছে! তবুও এরই মধ্যে হাসিমুখে কাজ করে যান ডিপ্লোম্যাটরা। সুন্দরী যুবতী আর মদের প্রতি পৃথিবীর প্রায় সবদেশের মানুষের দুর্বলতা। বিশেষ করে উপটৌকন হিসেবে, সৌজন্য হিসেবে যখন এসব আসে, তখন অনেক মানুষই লোভ সম্বরণ করতে পারেন না। মদ বা মেয়েদের বর্জন করে ডিপ্লোম্যাসী করা অনেকটা কলের জলে কালীপুজো করার মতো। কাজকর্মের তাগিদেই রোজ সন্ধেয় ডিপ্লোম্যাটদের, ককটেল-লাউঞ্জ স্যুট পরে মদ খেতে হয়, মেয়েদের সঙ্গে নাচতে হয়, খেলতে হয়, হাসতে হয়। বারুদ নিয়ে খেলা করলেও বারুদের আগুনে পুড়তে পারেন না ডিপ্লোম্যাটরা। আরো অনেক সতর্কতা দরকার। পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট বা সিভিল সাপ্লাই অফিসার বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ঘুষ খেলে ক্ষতি হয় কিন্তু দেশ রসাতলে যায় না। ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের থার্ড সেক্রেটারি বা একজন অতিসাধারণ অ্যাটাচি ঘুষ খেলে দেশের মহা সর্বনাশ হতে পারে। এভাবে বহু দেশের বহু সর্বনাশ হয়েছে, ভবিষ্যতেও নিশ্চয় হবে না
বড় বড় দেশের তুলনায় ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের মাইনে অ্যালাউন্স অনেক কম। তবুও সারা দুনিয়ার ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেলামেশা করতে হয় ওঁদের। চারিদিক থেকে প্রলোভন কম আসে না।
ইউনাইটেড নেশনস্-এর করিডরে বা কাফেতে মাঝে মাঝে দেখা হতো দুজনের। হাউ ডু ইউ ডু, ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ পর্যায়েই পরিচয়টা সীমাবদ্ধ ছিল। কদাচিৎ কখনও ডিপ্লোম্যাটিক পাটিতে দেখা হতো, সামান্য কথাবার্তা হতো। এর বেশি নয়।
কিছুকাল পরে আর্ট সেন্টার অফ দি ওরিয়েন্টের আমন্ত্রণে যশস্বিনী ভারতীয় নর্তকী কুমারী পদ্মবতী আমেরিকা ভ্রমণ শেষে এলেন নিউইয়র্ক। ইন্ডিয়ান মিশনের উদ্যোগে ও নিউইয়র্ক সিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় এই যশস্বিনী নর্তকীর নাচ দেখাবার ব্যবস্থা হলো।
পরের দিনই ভদ্রলোক ইউনাইটেড নেশন-এ মিঃ নন্দাকে ধরলেন। ইন্ডিয়ান মিউজিক, ইন্ডিয়ান ডান্স আমার ভীষণ ভালো লাগে। যদি কাইন্ডলি মিস পদ্মাবতীর প্রোগ্রাম দেখার…।
মিঃ নন্দা বললেন, নিশ্চয়ই। এই সামান্য ব্যাপারের জন্য এত করে বলবার কী আছে?
ভালো করে আলাপ-পরিচয়ের সেই হলো সূত্রপাত।