মিস কাউলকে নিয়ে কত বিদেশি ডিপ্লোম্যাট যে বিনিদ্র রজনী যাপন করেন, তার হিসাব দেওয়া মুশকিল। জংপুরার বীরবল রোডে মিস কাউলের ফ্ল্যাটে যান। সকাল, দুপুরে, বিকেলে-যখন ইচ্ছা। সব সময়ই দু-চারজন ডিপ্লোম্যাটকে দেখতে পাবেন। অবশ্য সন্ধের পর মিস কাউলকে আর পাবেন না। পার্টি, ককটেল, ডিনার। সব শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়। একটা, দেড়টা, দুটো, আড়াইটে। উইক-এস্তের পার্টিগুলো থেকে ফিরতে কখনও কখনও আরো দেরি হয়। মিঃ পার্কার, মিঃ বার্গম্যান বা আরো অনেকে অজন্তা-ইলোরা বা খাজুরাহের প্রাণহীন মর্মরমূর্তি দেখতে যাবার সময় প্রাণচঞ্চল মন-মাতানো মিস কাউলকে পাশে না পেলে শান্তি পান না।
দিল্লিবাসী বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের অনেকেই সামারে পাড়ি দেন নিজের নিজের দেশে। বিদেশি কূটনীতিবিদদের চারপাশে রোদন ভরা বসন্ত। মিস কাউলের মতো যাঁরা পার্কারের সঙ্গে একই প্লেনে সামার-কোর্সে যোগ দেবার জন্যে সেই সুদূর সাগর পারের অচিন দেশে যেতে না পারেন, তারা তখন চেমসফোর্ড ক্লাবে বিজনেসম্যান আর কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গ দান করেন। হয়তো মুসৌরী বা নৈনীতাল ঘুরে আসেন।
মিস ভরদ্বাজ অবশ্য এখনও বিদেশি ইউনিভার্সিটির সামার কোর্সে যোগ দেবার আমন্ত্রণ পাবার মতো হতে পারেননি। তবে- যাক গে সেসব।
কখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, কখনও আবার কিছু না বলেই মিস ভরদ্বাজ তরুণের কাছে আসা-যাওয়া শুরু করলেন।
কি ব্যাপার? তরুণ মিস ভরদ্বাজকে অভ্যর্থনা জানাতে জানাতে প্রশ্ন করে।
কেন, ডিসটার্ব করলাম নাকি?
মাই গড! ব্যাচিলার তরুণ মিত্রের ফ্ল্যাটে আপনার মতো অতিথির বিশেষ আগমন হয় না তো, তাই…।
সো হোয়াট?
তরুণ মিস ভরদ্বাজকে অভ্যর্থনা করে ড্রইংরুমে বসায়। গাড়োয়ালী ভৃত্যকে কফি দিতে বলে।
তরুণের ধারণা দিল্লির মেয়ে আর মাছির চাইতে অসভ্য কিছু হতে পারে না। এরা যে কোথা থেকে কিসের জীবাণু-বীজাণু এনে ছড়িয়ে দেবে, তা কেউ টের পাবে না। মিস ভরদ্বাজ নিবিড়ভাবে মিশতে চাইলেও তরুণ পারে না নিজেকে বিলিয়ে দিতে। মামুলি কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টা আর কফির পরই ইতি টানতে চায় সে। এক্সকিউজ মী মিস ভরদ্বাজ, একটা। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে…। সী ইউ এগেন।
মিস ভরদ্বাজ তবু তরুণের আশেপাশে ভনভন করতে ছাড়ে না। সময় সুযোগ পেলেই হাজির হয়। এমনি করেই একদিন থলি থেকে বেড়ালছানা বেরিয়ে পড়ে।
আই ওয়াজ টয়িং উইথ দি আইডিয়া অফ গোয়িং টু দি স্টেটস।
তরুণ খুশি হয়ে বলে, আমেরিকা যাবেন? খুব ভালো কথা।
কিন্তু…।
কিন্তু আবার কী?
ইউ মাস্ট হেল্প মী।
বলুন না কি সাহায্য করতে হবে?
ইন্ডিয়ান ডেলিগেশনে একটা টেম্পোরারি অ্যাপয়েন্টমেন্ট…।
আই অ্যাম সরি মিস ভরদ্বাজ, ও তো আমার ক্ষমতার বাইরে তাছাড়া…।
তাছাড়া আবার কি?
তরুণ মিত্র মিস ভরদ্বাজকে খুশি করেনি। কিন্তু বছর খানেক পরেই এই অনন্যার দেখা পেয়েছিল নিউইয়র্কে।…
তরুণের ভারি মজা লাগে দিল্লির কথা ভাবতে। আজকের মতো তখন কার্জন রোডে এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স হস্টেল, আশেপাশের এমপিদের বাংলোগুলোকে উপহাস করার জন্য মাথা তুলে দাঁড়াননি। কার্জন রোডের নোংরা সঁতসেঁতে ব্যারাক কনস্টিটিউশন হাউস নাম নিয়ে তখন আভিজাত্যের বড়াই করত। হরেক-রকমের নারী-পুরুষের বাস ছিল, এই কনস্টিটিউশন হাউসে। রাত দশটা সাড়ে দশটায় ডাইনিং হলের সার্ভিস বন্ধ হতো কিন্তু ঘরে ঘরে অমৃতরসধারা পানের উৎসব শুরু হতো তারপরে। সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়ার পালা। বন্ধ হতো, শুরু হতো অস্বাভাবিক অসাধারণের আবির্ভাবের পর্ব। সামনের রিসেপশন কাউন্টার এড়িয়ে ওঁরা যাতায়াত করতেন মাঝরাতের আবছা আলোয়। ওই রাতের অন্ধকারে কতজনের সৌভাগ্যসূর্য উঠত, আবার অস্ত যেতো।
চেক ন্যাশনাল ডে-র পার্টি অ্যাটেন্ড করে মিঃ ভোসলের বাড়িতে ডিনার খেয়ে ফিরতে ফিরতে তরুণের অনেক রাত হয়ে গেল। কনস্টিটিউশন হাউসের বড় বড় আলোগুলো তখন নিভে গেছে, ফাঁকা দিল্লি শহরটা প্রায় গ্রামের মতো নিঝুম হয়ে পড়েছে। আবছা আলোতে ঘরের চাবিটা দেখবার সময় স্ফুলিঙ্গের মতো এক টুকরো হাসির ঝলক তরুণের কানে আসতেই
মিস ভরদ্বাজ বললেন, দাউ টু-উক্রেটাস!
তার মানে?
এত সহজ কথাটা বুঝলেন না?
আই অ্যাম সরি মিস ভরদ্বাজ।
ওই আবছা আলোতেই মিস ভরদ্বাজের বিদ্রূপ মাখা হাসি ডিপ্লোম্যাট তরুণ মিত্রের দৃষ্টি এড়াল না। করিডরের পিলারটায় হেলান দিয়ে মিস ভরদ্বাজ বললেন, আপনিও তাহলে মাঝরাতের খদ্দের।
মিথ্যা তর্ক করে সময় নষ্ট করে না তরুণ মিত্র। একটু ভুল হলো মিস ভরদ্বাজ। আপনার মতো আমি মাঝরাতের খদ্দের নই, আমি দোকানদার। খদ্দের আসে কিন্তু ফিরিয়ে দিই।…আচ্ছা, গুড নাইট।
সে রাত্রে তরুণ মিত্র আর কিছু জানতে পারেনি, কিন্তু স্থির জানত মিস ভরদ্বাজ আমেরিকা যাবেনই।
কি করবেন মিস ভরদ্বাজ! শেরওয়ানী-চাপকান পরা পলিটিসিয়ানগুলো যেন এক-একটা নেকড়ে বাঘ। শিকার ধরতে এদের জুড়ি বোধকরি ভূ-ভারতে নেই। জর্ডনের জল না হলে যেমন খ্রিস্টানদের কোনো শুভ কাজ হয় না, আমাদের দেশেও তেমনি পলিটিসিয়ান না হলে কোনো কর্ম বা অপকর্ম সম্ভব নয়। একজিবিশন ওপন করতে এসে বনবিহারীলাল মিস ভরদ্বাজের পিঠ চাপড়ে বললেন, এই ওয়ান্ডারফুল ডেকরেশন করেছে এই সুইট ছোট্ট মেয়েটা!