ফরেন সেক্রেটারি তরুণকে নিয়ে তক্ষুনি প্রাইম মিনিস্টারের কাছে গেলেন। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে ডিনার খেতে খেতে উঠে এলেন প্রাইম মিনিস্টার। সব শুনে বেশ চিন্তিত হলেন। ছোট্ট একটা মন্তব্য করলেন, ইন্টেলিজেন্স কিছু সন্দেহ করছিল বেশ কিছুকাল ধরেই।
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টরকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠানো হলো প্রাইম মিনিস্টার্স হাউসে। তিনজনে মিলে শলাপরামর্শ শুরু হবার আগেই তরুণ বিদায় নিল।
এ খবর ফরেন মিনিস্ট্রির অনেকেই অনেক কাল জানতেন না। পরে অবশ্য অনেকেই জেনেছিলেন। স্ট্যালিনের রাজত্বকালে মস্কোর ইন্ডিয়ান এম্বাসীতে পরমেশ্বরন যখন পলিটিক্যাল কাউন্সেলার, তরুণ তখন তার অধীনে কাজ করেছে এবং একবার নয়, অনেকবার কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
পরমেশ্বরন তরুণকে নিজের কাছে রাখতে পারলে সব চাইতে সুখী হন। সব সময় তা সম্ভব হয় না। তবে ঘানা থেকে ফেরার আগেই তরুণকে ইউনাইটেড নেশনস পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন পরমেশ্বরন।
জান তো এবার তুমি ইউনাইটেড নেশনস-এ যাচ্ছো?
হাসি হাসি মুখে তরুণ উত্তর দেয়, হ্যাঁ স্যার।
বছর দুই-তিন ওখানে থাকলে তুমি একটি কমপ্লিট ডিপ্লোম্যাট হবে। পরমেশ্বরন একটু থেমে আবার বলেন, মেন পলিটিক্যাল কমিটিতে কাজ করলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি তোমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে!
টেলিফোন বেজে উঠল। কথা বললেন। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।
তরুণ বলল, মেন পলিটিক্যাল কমিটিতে তো পার্লামেন্টের একজন মেম্বার থাকবেন।
হ্যাঁ, একজন এমপি থাকবেন। তিনি তো তোমাদেরই তৈরি বক্তৃতা শুধু রিডিং পড়বেন। তবে ওঁদের নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় না। ওঁরা সরকারি পয়সায় কয়েক মাস নিউইয়র্কে থাকতে পারলেই মহা খুশি। তারপর খবরের কাগজের পাতায় যদি দু প্যারা বক্তৃতা ছাপা হয় তাহলে তো কথাই নেই।
তরুণ মুচকি মুচকি হাসে। বিদেশে থাকবার সময় কয়েকজন ওই ধরনের লোকের দর্শনলাভও হয়েছে ওই সামান্য অভিজ্ঞতাতেই।
যাই হোক সারা পৃথিবীর টপ ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে মেশবার এমন সুযোগ আর পাবে না। লিফট-এ উঠতে নামতে, ক্যাফেটেরিয়াতে চা-কফি-লাঞ্চ খেতে খেতে দু-চারজন ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা হবেই।
দিল্লিতে আসতে না আসতেই তরুণ আবার ইউনাইটেড নেশনস-এ যাচ্ছে শুনে অনেকেই চমকে উঠলেন। ডিপ্লোম্যাটদের কাছে এর বিরাট মর্যাদা।
সন্ধের পর কনস্টিটিউশন হাউসের ওই একখানা ঘরের আস্তানায় তরুণ পা দিতে না দিতেই টেলিফোন বেজে উঠল।
কনগ্রাচুলেশনস।
তরুণ চমকে গেল। এরই মধ্যে খবর ছড়িয়ে গেছে? টেলিফোন নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবল, হয়তো কাল ভোরেই দালালের দল হাজির হবে। বলবে, এক্সকিউজ মী স্যার। আপনি তো আবার বিদেশে যাচ্ছেন। আপনার টেপ রেকর্ডার, ট্রানজিস্টার, ক্যামেরা, বাইনোকুলার, ডিনার সেট, ওভার কোট, নাইলন শার্ট ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছু কিনতেই আমরা রাজি।
ভাবতেও গা-টা ঘিনঘিনিয়ে উঠল!
কিন্তু কি করবে? এর নাম দিল্লি। দেওয়ালে গান্ধীর ফটো লটকিয়ে ফ্রীজে বিদায় লুকিয়ে রাখাই এখানকার সামাজিক মর্যাদার অন্যতম নিদর্শন। অতীত দিনের বনেদী বাঙালির বাড়ির বৈঠকখানায় যেমন আলমারি ভর্তি সবুজপত্র দেখা যেত, তেমনি আজকের দিল্লির সম্রান্ত মানুষের ড্রইংরুমে দেখা যায় ওয়াইন গ্লাস আর ডিক্যান্টার-এর প্রদর্শনী। সারা পৃথিবীর মধ্যে দিল্লিই একমাত্র শহর যেখানে ড্রইংরুমে ফ্রীজ রেখে প্রচার করা হয় ঐশ্বর্যের মহিমা।
এসব দেখতে ভারি মজা লাগে তরুণের। কূটনীতিবিদদের কদর সব দেশেই আছে, কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষ কূটনীতিবিদ বা এম্বাসীর কর্মী দেখলে একটু যেন বেশি গদগদ হয়ে পড়ে। টাটা কোম্পানি বা বামা শেলের অফিসার এবং ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের চাইতে রেঙ্গুন বা ওয়াশিংটন ভারতীয় দূতাবাসের কেরানীর মর্যাদা এখানে অনেক বেশি। সত্যিকার ডিপ্লোম্যাট হলে তো কথাই নেই! হবে না? ওঁরা যে বিদেশে ঘুরে বেড়ান, টেপ-রেকর্ডার ট্রানজিস্টার-নাইলনের শার্ট আনতে পারেন! ভারতবর্ষের মানুষ নাকি ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শে দীক্ষিত! অথচ একটা সুইস ঘড়ি বা জাপানী ক্যামেরা দেখলে তো অধিকাংশ মানুষের জিভের জল গড়ায়!
তবে হ্যাংলামিটা যেন দিল্লিতেই বেশি।
গুডমর্নিং।
গুডমর্নিং!
মিস ভরদ্বাজ বলছি। চিনতে পারেন?
মাই গড! যাকে দেখলে অ্যাম্বাসেডররা পর্যন্ত গাড়ি থামিয়ে লিফট দেন, তাকে তরুণ মিত্র ভুলবে?
মিস ভরদ্বাজ কোনো উত্তর দিলেন না। কিন্তু বেশ বোঝা গেল বড় খুশি হয়েছেন। ছোট্ট একটু মিষ্টি হাসির রেশ ভেসে এলো টেলিফোনে।
তরুণ মিত্র আবার বলেন, বলুন কি খবর? কেমন আছেন?
মেনি থ্যাঙ্কস! ভালোই আছি।
ইতালীয়ান এম্বাসির এক ককটেল পার্টিতে মিস ভরদ্বাজের সঙ্গে তরুণ মিত্রের প্রথম আলাপ। ইন্টিরিয়র ডেকরেটর মিস ভরদ্বাজ আজেবাজে খদ্দেরের কাজ পছন্দ করেন না। শুধু বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের কাজ করেন উনি। ইতালীয়ন অ্যাম্বাসেডরের সিটিংরুম ও ড্রইংরুমও ডিজাইন করেছেন মিস ভরদ্বাজ। এ কাজ খুব বেশি দিন করছেন না। নতুন বিজনেস শিকারের আশায় কূটনৈতিক দুনিয়ায় নিত্য ঘোরাঘুরি করছেন।
দিল্লির ইন্টিরিয়র ডেকরেটররা শুধু ড্রইংরুম বা অফিসরুমই সাজিয়ে-গুছিয়ে দেন না, মনে হয় ভালো ভালো খদ্দেরদের মনের অন্দরমহলও সাজিয়ে-গুছিয়ে দিতে ভালোবাসেন। তাছাড়া দেশি বিদেশি ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে একটু নিবিড় করে মেলামেশায় ওদেরও আরো অনেকের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মিস ভরদ্বাজ সবে এই পথে পা দিয়েছেন। মিস প্রমীলা কাউলের মতো নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি অর্জনে এখনও অনেক দেরি।