তারপর প্রায় একশ বছর ধরে চলল ইংরেজের লুটপাট। জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে গেল ম্যাঙ্গানিজ আর কোকো। শত শত বছরে প্রকৃতির আশীর্বাদে যে বনানী গড়ে উঠেছিল, জাহাজ বোঝাই করে তাও নিয়ে গেল। হাজার হাজার সিন্দুক বোঝাই করে নিয়ে গেল সোনা আর হীরের তাল।
ইংরেজ যখন গোন্ডকোস্টের অনন্ত সম্পদ লুটপাটে মত্ত, তখন সবার অলক্ষে চব্বিশ বছরের এক স্কুলমাস্টার পাড়ি দিলেন আমেরিকা। নিঃসম্বল এই কৃষ্ণকায় রোমান ক্যাথলিক যুবক নিদারুণ শীতের রাতে পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে কাটিয়েছেন। ব্ল্যাক নিগার বলে ধিকৃত হয়েছেন আমেরিকার দ্বারে দ্বারে। কিন্তু তবুও তার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। দুটি ব্যাচিলার্স আর দুটি মাস্টার্স ডিগ্রী নেবার পর এলেন অ্যাটলান্টিকের এপারে, ভর্তি হলেন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে।
এমনি করে বারো বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনার পর ছত্রিশ বছরের নক্রুমা ১৯৪৭ সালে ফিরে এলেন নিজের জন্মভূমিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেশায় মাতাল করে তুললেন সত্তর লক্ষ দেশবাসীকে। সত্তর লক্ষ কৃষ্ণকায় সিংহের বজ্রমুষ্টিতে ইংরেজ না পালিয়ে পারল না।
সেদিন এই সত্তর লক্ষ মানুষ হাসিমুখে নিজেদের ভবিষ্যৎ তুলে দিল রাষ্ট্রনায়ক নকুমার হাতে।
ঘানার মানুষগুলো কালো কিন্তু বড় হাসি-খুশি ভরা। আনন্দে মেতে উঠতে বোধ করি এদের জুড়ি নেই সারা আফ্রিকায়। দূরাগত মানুষদের এরা বড় ভালোবাসে, বড় সমাদার করে। নিমন্ত্রণ করে বাদামের সুপ খাওয়ায়।
ঘানায় না গেলে কি তরুণ এসব জানত? জানত না। ঘানায় না গেলে আরো অনেক কিছু জানতে পারত না। আক্রা যে এত সুন্দর, এত আধুনিক শহর, তাও জানত না। অন্তরে অন্তরে নিজেদের ঐতিহ্যের জন্য অস্বাভাবিক গর্ববোধ করা সত্ত্বেও ঘানার মানুষ ভয়ে ভয়ে পশ্চিমী আধুনিকতাকে দূরে ঠেলে রাখেনি। তাই তো আক্ৰায় রয়েছে লারন্দির মত বিখ্যাত নাইটক্লাব।
তিন তিনটি বছর আক্ৰায় কাটিয়ে এসে তরুণের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।…
মিঃ পরমেশ্বরন লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হঠাৎ মুখ তুলে তাকালেন। তরুণের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে একটু হাসলেন। প্রশ্ন করলেন, প্রেসিডেন্ট নক্রুমাকে কেমন লাগলো?
অফিসিয়ালি অর আন-অফিসিয়ালি জানতে চাইছেন?
তুমি সত্যি ডিপ্লোম্যাট হয়েছ। টেল মী ইওর পার্সোনাল ওপিনিয়ন।
একজন অসামান্য প্রতিভা, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, তবে…
তবে কি?
যেভাবে চলছেন তাতে কিছুই বলা যায় না।
তার মানে?
প্রায় তিনশো কোটি টাকা ধার নেবার পরও যে দেশের অর্থনীতি টলমল করছে, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট যদি উনিশ-কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয়ে নিজের মর্মর-মূতি তৈরি করতে যান, তাহলে দেশের মানুষ কতদিন বরদাস্ত করবে তা বলা কঠিন।
ইউ আর রাইট মাই বয়।
এবার তরুণ হাসিমুখে বলে, তবে স্যার, প্রেসিডেন্ট নক্রুমা হ্যাঁজ এ চার্মিং পার্সোনালিটি। এমন ব্যক্তিত্ব যে কেউটে সাপকেও বশ করতে পারেন।
সাপুড়ে কিন্তু সাপের ছোবলেই মরে, তা জান তো?
দ্যাটস রাইট স্যার।
তরুণ মিত্র সম্পর্কে পরমেশ্বরনের হৃদয়ে বেশ কিছুটা কোমল জায়গা রয়েছে। কনিষ্ঠ সহকর্মীরূপে তরুণকে ভালোবাসার অনেক কারণ আছে। স্মার্ট, হ্যাঁন্ডসাম, ইন্টেলিজেন্ট। যে কোনো কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তাছাড়া কুটনৈতিক দুনিয়ার গোপন খবর জোগাড় করতে তরুণের জুড়ি ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে খুব বেশি নেই।
কেন, সেবার? টোকিও থেকে প্যান আমেরিকান ফ্লাইটে দিল্লি ফেরার পথে দুজন পাকিস্তানী ওর সহযাত্রী ছিলেন। পাকিস্তানী ডিপ্লোম্যাটরা ভাবতে পারেননি তাদের পিছনেই ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের তরুণ মিত্র বসেছিলেন। ওঁদের কথাবার্তায় তরুণ জানতে পারে, ইউ-এস-এয়ারফোর্সের একদল সিনিয়র অফিসার মাসখানেকের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত দেখতে আসবেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই কয়েক হাজার অফিসারের কোয়ার্টার তৈরি করা সম্ভব হবে? তাও আবার গিলগিট-পেশোয়ারের মতো জায়গায়!
জহুরীর কাছে কাঁচ আর হীরের পার্থক্য ধরতে যেমন কষ্ট হয় না, বুদ্ধিমান ডিপ্লোম্যাটের কাছেও তেমনি এই সব টুকরো টুকরো খবরের অনেক দাম, অনেক গুরুত্ব। তরুণ বেশ অনুমান করতে পারল পাকিস্তানে নাটকীয় কিছু ঘটছে।
পালামে যখন ল্যান্ড করল তখন সন্ধ্যা সাতটা। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকেই জয়েন্ট সেক্রেটারিকে টেলিফোন করল, কিন্তু পেল না। খবরের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিনা দ্বিধায় স্বয়ং ফরেন সেক্রেটারিকেই ফোন করল, স্যার, মাপ করবেন, বাট দেয়ার ইজ সামথিং ভেরী ইম্পর্টান্ট। জয়েন্ট সেক্রেটারিকে না পেয়ে আপনাকেই বিরক্ত করতে বাধ্য হচ্ছি।
পালাম থেকে ট্যাক্সি নিয়ে তরুণ ছুটে গিয়েছিল আকবর রোডে ফরেন সেক্রেটারির বাড়ি। বলেছিল, স্যার, ওঁদের কথা শুনে মনে হলো ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়। সন্দেহটা আরো গাঢ় হলো যখন দেখলাম ওঁরা ব্যাংককে নেমে সিঙ্গাপুরের প্লেন ধরতে ছুটে গেলেন। আই অ্যাম সিওর ওঁরা কে-এল-এম ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে কলম্বো হয়ে করাচি গেলেন।
ডিনারের সময় হয়েছিল কিন্তু ডিনার না খেয়েই বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হলেন ফরেন সেক্রেটারি। ড্রাইভারকে গাড়ি আনার কথা বলে ভিতরের ঘরে গিয়েই প্রাইম মিনিস্টারকে টেলিফোন করে শুধু বললেন, খুব জরুরি ব্যাপার। এক্ষুনি একটু দেখা করতে চাই স্যার।