তরুণ মুখে কিছু উত্তর দেয়নি, মুখ নিচু করে মুচকি হেসেছিল।
বেশ কেটেছে রেঙ্গুনের দিনগুলো। কখনও কিচেনের দোরগোড়ায় চেয়ার টেনে নিয়ে আম্মাজানের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেছে, কখনও আবার আব্বাসের লুঙ্গি পরেই সোফায় শুয়ে শুয়ে টেপ রেকর্ডারে ভাটিয়ালী গান শুনেছে।
হাসান পরিবারের সঙ্গেও তরুণের হৃদ্যতা হতে সময় লাগল না।…
দেশের কথা বলো না ভাই, শুনলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়, প্রায় ছল ছল চোখে তরুণ হাসানকে বলতো।
মন খারাপ হবে না? ঢাকা-উয়াড়ীর অলিতে-গলিতে যে ওর জীবনের সব চাইতে স্মরণীয় স্মৃতি মিশে আছে। পোগোজ স্কুলে পড়া, পুরনো পল্টন, রমনা বা বুড়ীগঙ্গার পাড়ে বিকেলবেলা ঘুরে বেড়ান, খেলাধুলো করা, আড্ডা দেওয়ার কথা মনে পড়লে আর কিছু ভালো লাগে না। লন্ডন, মস্কো, ওয়াশিংটনও ভালো লাগে না। নাইল হিলটনের ডিনার খাবার চাইতে মণি কাকিমার হাতের নারকেলের গঙ্গাজলি বা ঢাকাই পরটা অনেক অনেক বেশি ভালো লাগত।
হাসানের স্ত্রী রাবেয়া, কারমান্নেসা স্কুলের ছাত্রী। কারমান্নেসা স্কুলের কথা মনে হলেই যে মনে পড়ে যায় আরেক জনের কথা। মুহূর্তের মধ্যে মনটা যেন পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী- বুড়ীগঙ্গার মতো মাতলামি শুরু করে দেয়।…
উয়াড়ীর রামকৃষ্ণ মিশন রোডের প্রায় মোড়ের মাথাতেই ছিল তরুণদের বাড়ি। বুড়োরা বলতেন, বরদা উঁকিলের বাড়ি। অল্পবয়সীর দল বলতেন, কানাই উঁকিলের বাড়ি। তরুণের দাদু বরদাচরণ সেনগুপ্ত সেকালের মস্ত নামজাদা উকিল ছিলেন। ফৌজদারি মামলায় ঢাকা-ময়মনসিংয়ে বরদা সেনগুপ্তের জুড়ী ছিল না কেউ। বড় বড় মামলায় চট্টগ্রাম-সিলেট থেকেও ডাক পড়ত।
বরদাচরণের সাধ ছিল তিন ছেলেকেই ওকালতি পড়ান। তা হয়নি। বড় দুই ছেলে কোর্ট-কাছারির ধার দিয়েও গেলেন না। বড় ছেলে পোস্টাফিসে ও মেজ ছেলে রেল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। বরদা উঁকিলের সাধ পূর্ণ করলেন ছোট ছেলে কানাইবাবু। বাপের মতো পসার বা নাম ডাকা না হলেও উয়াড়ীর মধ্যে ইনিও বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন।
বাবা কানাইবাবুর মতো তরুণও পড়ত পোগোজ স্কুলে, খেলত রমনার মাঠে। বাকি সময় কাটাত টিকাটুলির গুহবাড়িতে। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনের সন্ধিক্ষণের মিষ্টি মধুর সোনালী দিনগুলিতে গুহবাড়িই ছিল তার প্রধান আকর্ষণ। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে বলেই মানুষ পৃথিবীতে আছে, নয়তো কোথায় সে চলে যেত! প্রত্যেক মানুষের জীবনেও এমনি একটা অদৃশ্য শক্তি কাজ করে-যে শক্তি তাকে প্রেরণা দেয়, শক্তি জোগায়। যার জীবনে এই অদৃশ্য শক্তির প্রেরণা নেই, সে মহাশূন্যে বিচরণ করে।
টিকাটুলির গুহবাড়ির ইন্দ্রাণীকে ঘিরেই তরুণের জীবনের সব স্বপ্ন দানা বেঁধে উঠেছিল। সে কাহিনি কেউ জানত, কেউ জানত না। কিন্তু ওরা দুজনে জানত, বিধাতাপুরুষ ওদের বিচ্ছিন্ন করবেন না, করতে পারেন না। বুড়ীগঙ্গার জল শুকিয়ে যেতে পারে কিন্তু তরুণের জীবন থেকে। ইন্দ্রাণী বিদায় নিতে পারে না বলেই সেদিন মনে হতো।
মনে তো কত কিছুই হয়। ভেবেছিল কি অমন সর্বনাশা দাঙ্গায় সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? কোর্টে অতবড় মামলায় জেতার পর তরুণের মার জন্য অমৃতি কিনে বাড়ি ফিরছিলেন কানাইবাবু! সে অমৃতি আর খাওয়া হলো না তরুণের মার। একটা ছোরার আঘাতে সব আনন্দ চিরকালের মতো শেষ হলো তার।
সারা ঢাকা শহরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। কত সংসারে যে আগুন লাগল, তার ইয়ত্তা নেই! কত নিরপরাধ মানুষের রক্তে যে বুড়ীগঙ্গার জল লাল হলো, সে হিসাবও কেউ রাখল না।
বাবার মৃতদেহ কোনোমতে দাহ করে বাড়ি ফিরে এসে ওই লাইব্রেরি ঘরে পাথরের মতো বসে রইল তরুণ। যখন হুশ হলো তখন সারা টিকাটুলি প্রায় শ্মশান হয়ে গেছে। পাগলের মতো চিৎকার করে সারা টিকাটুলি ঘুরেও ইন্দ্রাণীর হদিস পেল না তরুণ।…
টিকাটুলির শ্মশানের আগুন আজো তার মনের মধ্যে অহরহ জ্বলছে। মাকে হারাবার পর নিঃসঙ্গতা যত বেড়েছে ইন্দ্রাণীর কথা তত বেশি মনে পড়েছে।
হাসানের স্ত্রী রাবেয়ার কথায় তাই তো তরুণ হারিয়ে ফেলে নিজেকে। হাজার হোক ডিপ্লোম্যাট। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, দিদি ওসব কথা আর বলো না। তার চাইতে মাংসের গরম গরম পকোড়া খাওয়াও।
পকোড়ার পর কফি খেতে খেতে হাসান বলে, রাবেয়া, অন্নদাশঙ্করের কবিতা পড়েছ? রাবেয়ার উত্তর পাবার আগেই হাসান আবার বলে–
ভুল হয়ে গেছে
বিককুল
আর সব কিছু
ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয় নি কো নজরুল
অ্যান্ড হাসান অ্যান্ড তরুণ…
তরুণের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। বলল, উঁহু! হলো না।
হাসান জিজ্ঞাসা করল, হলো না আবার কি?
হবে-নজরুল অ্যান্ড রাবেয়া অ্যান্ড…
রাবেয়া মুচকি হাসতে হাসতে হাসানকে বলল, হেরে গেলে তো আমার ডিপ্লোম্যাট দাদার কাছে।
হাসান আর হারতে পারে না। তুমি যদি অকে ডিপ্লোম্যাট কও, আমি হালা কমু।
কি আনন্দেই কেটেছে কায়রোর দিনগুলো। রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অহর্নিশি ইন্ডিয়ান পাকিস্তান এম্বাসির লড়াই চলত। ভারতবর্ষে মুসলমান নির্যাতনের অলীক কাহিনি প্রচার করে পাকিস্তান এম্বাসী আরবদের মন জয় করার চেষ্টা করত। আর অতীতের পশ্চিমী আধিপত্য ও শোষণের বিরুদ্ধে আরবদের জয়যাত্রাকে প্রতি পদক্ষেপে স্বাগত জানাত ইন্ডিয়ান এম্বাসী। বোম্বে থেকে জাহাজ বোঝাই করে হজযাত্রীরা মক্কা যান। অনেক স্পেশ্যাল প্লেনও যায় বোম্বে থেকে। ওমান উপসাগরের মুখে এমনি হজযাত্রী একটা ভারতীয় জাহাজের নজরে পড়ল দূরের একটা পাকিস্তানী কার্গো জাহাজ। কার্গোর ক্রেটগুলো দেখে সন্দেহ হয়েছিল ভারতীয় জাহাজের কয়েকজন অফিসারের। ক্যাপ্টেন একটা কোড মেসেজ রেডিও মারফত পাঠিয়ে দিলেন বোম্বে। কয়েকদিন পর কাবুল রেডিওর একটা ছোট্ট খবরে সন্দেহটা আরো দৃঢ় হলো। ইতিমধ্যে আম্মান থেকে একটা ডিপ্লোম্যাটিক ডেসপ্যাঁচে জানা গেল কদিন আগে একটা ডিপ্লোম্যাটিক পার্টিতে জর্ডন ফরেন মিনিস্ট্রির একজন সিনিয়র অফিসার ইজরাইল-আরব সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে মন্তব্য করেছেন যে বন্ধু মুসলিম রাষ্ট্রও যদি ওদের হেল্প করে তাহলে কি করা যাবে? এইসব বিন্দু বিন্দু খবর যখন এক করা হলো তখন আর সন্দেহ রইল না। এসব খবর কায়রোর ইন্ডিয়ান এম্বাসিতে পৌঁছতে দেরি হয়নি।