জোসেফ বলত, অল গ্লোরি টু নাসের!
ওই আড্ডাখানায় কে হঠাৎ বলে উঠত, কেন?
জোসেফ নাটকীয় ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠত, মাই ডিয়ার বেবিজ! তোমরা জান না, আমি বিয়াল্লিশ বছর বয়সে আমাদের মিনিস্ট্রির ক্যান্টিন কমিটির সেক্রেটারি পর্যন্ত হতে পারিনি, আর আমাদের ডিয়ার ডার্লিং নাসের চৌত্রিশ বছর বয়সে পৃথিবী নাচিয়ে দিল!
ডিয়ার ডার্লিং নাসেরই বটে। শুধু মিশরে নয়, সারা আরব দুনিয়ার যৌবনের প্রতিমূর্তি নাসের। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি নারী-পুরুষের হৃদয়ে তার আসন। পৃথিবীর অন্যতম ঘৃণিত মানুষদের সে যে সারা দুনিয়ার সামনে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাই তো আরব দেশে কালা ভারতীয়দেরও মর্যাদা।
কায়রোর কুটনৈতিক জগতে ইন্ডিয়ান মিশন সত্যি এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। বড় বড় দেশে ইন্ডিয়ান মিশনকে থোড়াই কেয়ার করে! প্যাঁচে না পড়লে ইন্ডিয়ার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করার প্রশ্নই ওঠে না। কায়রোয় তা নয়। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নাসের ভারতের সঙ্গে পরামর্শ করবেনই। আন্তর্জাতিক পরিবারের মধ্যে ভারত-মিশর পরমাত্মীয়।
কায়রোকে তরুণ ভুলতে পারে না আরো অনেক কারণে।
ইন্ডিয়ান এম্বাসির একদল ডিপ্লোম্যাট ও তাদের স্ত্রীরা সেদিন দল বেঁধে কায়রো টাওয়ার রিভলবিং রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গিয়েছিলেন। মিঃ অ্যান্ড মিসেস পুরি, মিঃ অ্যান্ড মিসেস সিং, মিঃ অ্যান্ড মিসেস মিশ্র, দিল্লির নর্দান টাইমসের স্পেশ্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ও তার স্ত্রী সুনীতা এবং আরো তিন-চারজন মিলে মহানন্দে ডিনার খাওয়া হলো। স্টিমড মিট আর জোসেফের কমেন্টারী–দুই-ই একসঙ্গে উপভোগ করলেন সবাই।
ডিনার খাওয়ার পর ইজিপসিয়ান ব্ল্যাক কফি খাবার সময় মিঃ পুরি কফির পেয়ালা তুলে। প্রপোজ করলেন, আগামী জয়েন্ট ডিনারের আগে তরুণের বিয়ে করতেই হবে, নয়তো…
জোসেফ ফোড়ন কাটল, নয়তো ইন্ডিয়ান ফরেন পলিসি বরবাদ হবেই।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরুবার পথে মিঃ কলহান হঠাৎ একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, হাউ আর ইউ হাসান?
ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, হাসান উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে দেয়।
সৌজন্যমূলক দুটো একটা কথা বলার পর মিঃ কলহান জিজ্ঞাসা করলেন, হাসান, হ্যাভ ইউ মেট আওয়ার নিউ কলিগ সেনগুপ্ত?
কই না তো। বাঙালির সঙ্গে দেখা করার লোভে হাসান টেবিল ছেড়ে একটু এগিয়ে এসে বলল, উনি আছেন নাকি আপনাদের দলে?
মিঃ কলহান আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, দুই বাঙালি এক হয়েছে, এবার তো তোমরা সারা দুনিয়া ভুলে যাবে। সো ক্যারি অন মাই বয়েস! গুড নাইট!
ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে বাঙালি যেমন দুর্লভ, পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে বাঙালির প্রাচুর্য ঠিক তত বেশি। এর কারণ অবশ্য পাকিস্তানের সামরিক একনায়কদের বাঙালি-প্রীতি নয়; বরং ঠিক তার উল্টোটাই সত্য। বাঙালি সিনিয়র অফিসারদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখা করাচি রাওয়ালপিন্ডির পাঠান বীরেরা খুব নিরাপদ মনে করেন না। সেজন্য পাকিস্তানের কৃষি, মৎস্য, পরিবার পরিকল্পনা বা রেডিওতে কিছু ছোট বড় বাঙালি অফিসার পাওয়া যাবে। সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্টও বাঙালি হতে পারে কিন্তু তারপর খবরদার! জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা এস-পি বা হোম মিনিস্ট্রির গোয়েন্দা বিভাগে বা দেশরক্ষা দপ্তরে? নো অ্যাডমিশন ফর ইস্ট পাকিস্তানিজ! তাই তো পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে কিছু বাঙালিকে ভর্তি করে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে এবং করাচি রাওয়ালপিন্ডি স্ট্যাটিসটিক্স প্রচার করে বাঙালি-প্রীতির ঢাক বাজাচ্ছে।
যাই হোক, পাকিস্তান মিশনে বাঙালি দেখা যায়। চাকরির খাতিরে যাই করুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের কোনো বাঙালিকে কাছে পেলে এঁরা সারা দুনিয়া ভুলে যান। রাজনীতির চাইতে পদ্মার ইলিশ মাছের বিষয় আলোচনা করাই পাকিস্তানের বাঙালি ডিপ্লোম্যাটরা বেশি পছন্দ করেন। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যে সব বাঙালি আছেন, তারাও এঁদের পেলে আর কাউকে চান না। তরুণও চায় না। এই তো রেঙ্গুনে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে কি আনন্দই করেছে।
সেও এক দুর্ঘটনা? রেঙ্গুন চিড়িয়াখানায় সেদিন লোকে লোকারণ্য। স্নেক-কিসিং-শঙ্খচুড় কোবরা সাপকে সাপুড়ে চুমু খাওয়ার খেলা দেখাবে বলে ভীষণ ভিড়। আমেরিকান টুরিস্টরা তো ভয়ের চোটে কাছেই এগুলো না। একদল বর্মী ছেলেমেয়ের সঙ্গে কিছু ভারতীয়, কিছু চীনা লোকই সামনের দিকে ভিড় করেছিল। সাপকে চুমু খাওয়ার খেলা দেখতে দেখতে আব্বাসউদ্দীন মুগ্ধ হয়ে নিজের অজ্ঞাতসারেই বাংলায় বলে উঠল, বাপরে বাপ!
ব্যস! ওই বাংলা শুনেই তরুণ আলাপ করেছিল আশ্বাসের সঙ্গে। আলাপের শেষে থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ বলেই তরুণকে ছেড়ে দেয়নি সে। হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে আম্মাজানকে জানিয়েছিল বাঙালি ধরে এনেছে।
ওই প্রথম দিনের পর আম্মাজানের স্নেহের আকর্ষণে তরুণ নিজেই যেত। ছুটির দিনে তরুণকে রান্না করে খেতে হয়নি কোনোদিন! আম্মাজানের হুকুম ছিল, ছুটির দিনেও যদি আমার এখানে খেতে না পার তবে আর আসতে হবে না। আমাকে আম্মাজান বলেও ডাকবে না, বুঝলে!