- বইয়ের নামঃ ডিপ্লোম্যাট
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. কর্মজীবন আর সংসারজীবন
হে দূর হইতে দূর, হে নিকটতম,
যেথায় নিকটে তুমি সেথা তুমি মম;
যেথায় সুদূরে তুমি সেথা আমি তব।
কর্মজীবন আর সংসারজীবনের দুটি গোলপোস্টের মাঝখানে দায়িত্ব কর্তব্যের ফুটবল পেটাতে পেটাতেই অধিকাংশ মধ্যবিত্তের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিছু মানুষের বিচরণক্ষেত্র আরো বিস্তৃত, আরো রঙিন। কিছুটা বিস্তৃত, কিছুটা রঙিন হওয়া সত্ত্বেও সমাজসংসারে এদের নোঙর বাঁধা। চৌরঙ্গির অলিতে-গলিতে ঘোরাঘুরি বা সন্ধ্যার অন্ধকারে মিউজিয়ামের পাশে লুকিয়ে রিকশা চড়ে যৌবনের অলকানন্দা-অমরাবতী ভ্রমণের মেয়াদ কতটুকু, মীর্জাপুর বা রাসবিহারী অ্যাভিন্যুর ঘরবাড়ি ছেড়ে বোম্বে সেক্স অফিসের মিস সোন্ধিকে নিয়ে মেরিন ড্রাইভ বা চার্চ গেটের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করারই বা স্থায়িত্ব কতক্ষণ?
দিনের আলো ফুরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে-চুরিয়ে স্বাধীনতা উপভোগের পর্ব শেষ হয়। সূর্যাস্তের পর সব পাখি ফিরে আসে ঘরে। শনি-মঙ্গল-রাহুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই একদিন সব থেমে যায় প্রায় সবার।
ডিপ্লোম্যাট-কূটনীতিবিদরা নিশ্চয়ই স্বতন্ত্র। মীর্জাপুর বা রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ছেলে হয়েও সারা দুনিয়ায় তাদের বিচরণ, তাদের সংসার। বিশ্বসংসারের কত রঙ-বেরঙের নারী-পুরুষের সঙ্গে তাদের লেনদেন। দেশে-দেশে ছড়িয়ে থাকে এঁদের স্মৃতি, প্রাণের মানুষ, মনের টুকরো টুকরো স্বপ্ন।
তরুণ মিত্র যেদিন ফরেন সার্ভিসে ঢুকে কূটনীতিবিদদের তালিকায় নিজের নাম জুড়েছিলেন, সেদিন সত্যি উনি তরুণ ছিলেন। সেদিনের পর মিসিসিপি-ভলগা-গঙ্গা বেয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক জল-ঝড়, অনেক শীত-বসন্ত পিছনে ফেলে এসেছেন।
ফায়ার প্লেসের ধারে রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে বাকি হুইস্কিটা হঠাৎ গলায় ঢেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তরুণ মিত্র। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে খালি গেলাসটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন স্টাডিতে। অতি পরিচিত পৃথিবীর মানচিত্রের সামনে দাঁড়ালেন। পৃথিবীর সমস্ত মহাদেশ, মহাসাগরের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ল্যান্ডিং এয়ারক্রাফট-এর কমান্ডারের মতো খুঁজতে লাগলেন রানওয়ে। অনেক দিনের অনেক স্মৃতির বোঝা নিয়ে মনের বিমান ল্যান্ড করাতে গিয়ে অনেকগুলো এয়ারপোর্টের অনেক রানওয়ের হাজার হাজার আলো জ্বলে উঠল। দিল্লি…কায়রো…লন্ডন…মস্কো নিউইয়র্ক…হংকং…টোকিও এবং আরো কতত! এক সঙ্গে যেন সমস্ত কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ল্যান্ডিং সিগন্যাল আর নির্দেশ পেলেন ডিপ্লোম্যাট তরুণ মিত্র।
আরো কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর দুপা ডানপাশে সরে এলেন। চোখের সামনে নজরে পড়ল দিল্লি।
.
সো ইউ হ্যাড অ্যান ইন্টারেস্টিং স্টে ইন ঘানা… পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি ও ইউনাইটেড নেশনস ডিভিশনের হেড, পরমেশ্বরন হাসতে হাসতে ছোট্ট মন্তব্য করলেন।
তরুণ মিত্র বলল-হ্যাঁ স্যার।
মুহূর্তের জন্য দুজনেই চুপচাপ। তরুণ আবার বলে, আক্ৰায় পোস্টিং পেয়ে মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ভালোই…।
পরমেশ্বরন ওয়ারলেস ট্রানসক্রিপ্টের ফাইলটা সরিয়ে রেখে বললেন, ব্ল্যাক আফ্রিকায় পোস্টিং না পেলে কোনো ডিপ্লোম্যাটই ঠিক পুরোপুরি ডিপ্লোম্যাট হতে পারে না।
আজ সত্যি সত্যিই সে-কথা বিশ্বাস করি।
রেঙ্গুন থেকে ঘানা। তরুণ মোটেও খুশি হতে পারেননি! ভেবেছিলেন কন্টিনেন্টে পোস্টিং পাবেন। কিছুদিন আগে ফরেন সার্ভিস ইন্সপেক্টরেটের একজন ডেপুটি সেক্রেটারি রেঙ্গুনের ইন্ডিয়ান এম্বাসী ভিজিট করতে এসে বলেছিলেন, ঠিক মনে নেই, বাট সামওয়ান টোল্ড মী যে তুমি এবার কন্টিনেটে কোনো পোস্টিং পাবে।
ফরেন সার্ভিসের অধিকাংশ নবীন কূটনীতিবিদদের মতো ব্ল্যাক আফ্রিকার নাম শুনেই তরুণের পিত্তি জ্বলে উঠেছিল। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বয়ং অ্যাম্বাসেডরকে পর্যন্ত মনের কথা জানিয়েছিল। অ্যাম্বাসেডর তরুণের কথা শুনে শুধু মুচকি হেসেছিলেন, মুখে কিছু বলেননি। প্রায় মাসখানেক পরে অ্যাম্বাসেডর একদিন তরুণকে ডেকে বললেন, স্পেশ্যাল সেক্রেটারি তোমাকে ঘানাতেই চান।
সুতরাং আর অযথা বাক্যব্যয় না করে তরুণ কোকো আর সোনার দেশ ঘানায় গিয়েছিল। গিনি উপসাগরের পাড়ের আক্ৰায় কাটিয়েছে তিন বছর। কিন্তু গিনি উপসাগর বা দুরের দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের গর্জন ছাপিয়ে কানে এসেছে প্রেসিডেন্ট নকুমার তীব্র অহমিকার অসহ্য উল্লাস।
স্নিগ্ধ, শান্ত, বিচিত্র প্রকৃতির ছোট্ট কালো দুরন্ত ছেলে হচ্ছে ঘানা। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে চলে গিয়েছে তুলনাহীন বালুকাময় বেলাভূমি। সেই সুন্দর সুদীর্ঘ বেলাভূমি কখন যেন হারিয়ে যায় ঘন-কালো বনানীর মধ্যে। এই সীমাহীন অরণ্য আর বালুকাময় বেলাভূমিতেই লুকিয়ে আছে সোনার সংসার। তাই তো নাম ছিল পোণ্ডকোস্ট! পশ্চিম আফ্রিকার সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নেবার পর এলো ডেন আর ডাচরা। ফেরিওয়ালা সেজে ব্যবসা করতে এলো ইংরেজ। দেখতে দেখতে একদিন ফেরিওয়ালাই হলো মালিক।