ড্রাইভার সসম্ভ্রমে বলল, জী!
-আর হ্যাঁ, আজই ভাড়া নিবি না। ফেরার দিন দাদার কাছে সব শোনার পর ভাড়া পাবি।
-জী।
আমি মহীউদ্দীন সাহেবকে বললাম, ও আমাদের ঠিকই পৌঁছে দেবে। ওকে ভাড়াটা নেবার অনুমতি দিন। তা না হলে বড়ই অস্বস্তি বোধ করব।
মহীউদ্দীন সাহেব একটু হেসে বললেন, আমি জানি ও আপনাদের ঠিকই পৌঁছে দেবে কিন্তু আপনার কাছ থেকে সব শোনার পর ভাড়া দিলে আমি মনে শান্তি পাব।
এবার উনি জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ট্রেনের সময় স্টেশন মাস্টার ডিউটিতে থাকবেন না বলেই এ-এস-এম-এর কাছে আপনার টিকিট থাকবে। উনি আপনাকে ট্রেনেও চড়িয়ে দেবেন। মনে হয় কোন অসুবিধা হবে না।
জয়ন্তী কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বললেন, আপনি যখন ব্যবস্থা করেছেন, তখন অসুবিধে যে হবে না, তা আমি ভাল করেই জানি।
আমরা দুজনেই ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে অটো-রিকশায় উঠি। অটো-রিকশা স্টার্ট করার ঠিক আগে নিত্য আমাকে বলল, বাচ্চু ফেরার পথে তুমি কিন্তু কয়েকদিন এখানে থাকবে।
–হ্যাঁ, থাকব বৈকি!
এবার ও জয়ন্তীকে বলে, আপনিও যদি ফেরার পথে অন্তত একটা দিন থেকে যান, তাহলে খুব খুশি হবো।
–যদি রংপুর থেকে একদিন আগে রওনা হতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই থাকব।
মহীউদ্দীন সাহেব আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুধু নিত্যবাবুর না, আমারও নেমন্তন্ন রইল।
আমি হাসলাম।
জয়ন্তী বললেন, তা জানি।
ভোরবেলায় যখন শিয়ালদ’ স্টেশনে বনগাঁ লোক্যালে চড়ি, তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, এত সব ঘটে যাবে। কোথায় ছিলেন পার্ক সার্কাসের মাসীমা-মেলোমশাই, অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় আর জয়ন্তী? এদের কারুর সঙ্গেই আমার পরিচয় হবার কথা নয় কিন্তু এখন বার বার মনে হচ্ছে, কবে মাসীমার বাড়ি যাব, কবে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দেব? আর জয়ন্তী?
–কী ভাবছেন?
ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন ভেসে গিয়েছিলাম। জয়ন্তীর প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফিরে আসে। বলি, আজ সারা দিনের কথা ভাবছি। বনগাঁ লোক্যালে কারুর সঙ্গে আলাপ হবে, তাও ভাবিনি, আবার বর্ডারে এতজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে, তাও আশা করিনি।
-শুধু আলাপ-পরিচয় কেন বলছেন? মনে হচ্ছে সবার সঙ্গেই যেন কত দিনের পরিচয়।
–ঠিক বলেছেন। একটু থেমে বললাম, মাসীমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে।
–উনি বড় বেশী স্নেহপরায়ণা।
–মা-মাসীরা একটু বেশী স্নেহপরায়ণা না হলে কী ভাল লাগে? এর কাছে একটু বেহিসেবী স্নেহ-ভালবাসা না পেলে মন ভরে না।
জয়ন্তী একটু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার মা নিশ্চয়ই আপনাকে খুব বেশী ভালবাসেন?
আমিও হাসি। বোধহয় একটু ম্লান হাসি। বলি, সারা জীবনের মাতৃস্নেহ আমি সাড়ে তিন বছর বয়সের মধ্যেই উপভোগ করেছি বলে তিনি আর বেঁচে থাকারই প্রয়োজনবোধ করলেন না।
আমার কথা শুনে উনি যেন চমকে উঠলেন। বললেন, ঐ অত ছোটবেলায় আপনি মাকে হারিয়েছেন?
মুখে না, শুধু মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ।
নাভারণ বাজার পিছনে ফেলে অটো-রিকশা এগিয়ে চলে। আমি আপন মনে সিগারেট খেতে খেতে এদিক-ওদিক দেখি ও কত কি ভাবি।
গদখালি পেঁছিবার খানিকক্ষণ আগে জয়ন্তী জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো? কোন কথা বলছেন না যে!
-কী বলব বলুন?
সত্যি, কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। ভাবছিলাম, যেসব আলাপ পরিচয় হয়ত দীর্ঘস্থায়ী হবে না, সেখানে বেশী ঘনিষ্ঠ হওয়া কী ঠিক? এই যে মাসীমাকে আমার এত ভাল লেগেছে কিন্তু কদিন ওর সঙ্গে দেখা হবে? আদৌ দেখা হবে কী? এই জয়ন্তীর সঙ্গে কোন একজনের এমন কিছু মিল আছে যে ওকে কোন সময়েই খুব দূরের মানুষ মনে করতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু জীবনে কী আর কোনদিন এর সঙ্গে দেখা হবে?
জয়ন্তী বললেন, প্রশ্ন না করলেই কী কিছু বলতে নেই?
আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, অনেকে বলেন, রেলগাড়ির পরিচয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই যদি সত্যি হয় তাহলে…
-আপনি তো আচ্ছা লোক! সাংবাদিক হয়েও এইসব বিশ্বাস করেন?
–বিশ্বাস করি না কিন্তু যদি সত্যি হয়?
জয়ন্তী একটু হেসে বললেন, আপনি নেহাতই ছেলেমানুষ!
-বোধহয়। এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলি, পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। যে জীবনে যা কিছু আঁকড়ে ধরতে যায়, তাই যখন হারায়, তখন তার মনে একটু ভয় থাকা স্বাভাবিক নয় কী?
কথাটা বলেই মনে হলো, না বলাই উচিত ছিল। আমি কী পেয়েছি যে হারাবার ভয় করছি?
অটো-রিকশা গদখালি পার হলো।
আমার কথা শুনে উনি শুধু একটু হাসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী আজই যশোর থেকে ঢাকা যাবেন?
যশোরে একটু কাজ আছে। তাছাড়া ঢাকার শেষ ফ্লাইটও দুপুরের আগেই ছেড়ে যায়।
–তাহলে আজ যশোরে থাকবেন।
-হ্যাঁ।
–আবার কবে ফিরবেন?
–দশই ডিসেম্বর আমাকে কলকাতায় থাকতেই হবে।
দুএক মিনিট পরে জয়ন্তী আবার প্রশ্ন করেন, আপনি তো দিল্লী থাকেন?
হ্যাঁ।
কবে দিল্লী ফিরবেন?
-যদি ভাল লাগে তাহলে আট দশ দিন কলকাতায় থাকব; আর ভাল না লাগলে তার আগেই চলে যাব।
ও একটু অবাক হয়ে বলে, আট দশ দিনও কলকাতা ভাল লাগবে না?
আমি একটু ম্লান হাসি হেসে বলি, দিল্লীতে কিছুদিন কাটাবার পরই মনে হয়, কলকাতায় ছুটে চলে যাই। মাঝে মাঝেই কলকাতা চলে আসি কিন্তু কিছুতেই বেশী দিন থাকতে পারি না।
–কেন?
আমি যেন আপন মনেই বলি, কেন? তারপর বলি, কলকাতার পথে-ঘাটে আমার এত সুখ-দুঃখের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে যে বেশী দিন থাকতে পারি না।