আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, নিশ্চয়ই থাকব।
.
০৪.
আমার আর জয়ন্তীর বিদায় সম্বর্ধনাও মন্দ হলো না। হাজার হোক চেকপোস্টের ওসি সাহেবের বন্ধু! সেই সকাল থেকে এই অপরাহ্ন বেলা পর্যন্ত, চেকপোস্টে ও কাস্টমস কলোনীতে কাটিয়ে অনেক নতুন বন্ধু হলো। সত্যি ভাল লাগল। ঐ খাকি পোশাক দেখলেই আমরা ভুলে যাই যে ঐ পোশাকের মধ্যেও একটা মানুষ লুকিয়ে থাকে। এবং আমাদের আর পাঁচজনের মতই ওদের জীবনেও সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। পুলিস বা কাস্টমস-এর লোকজনদের কী মন নেই? না মায়া-মমতা স্নেহ-ভালবাসা নেই।
এই তো কাস্টমস-এর নীরোদবাবু বলছিলেন, সাধারণত সন্ধ্যে হতে না হতেই বর্ডার দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।
–কেন? তখন কী দুদিকের চেকপোস্ট বন্ধ হয়ে যায়?
-না, না, সারা রাত ধরেই দুদিকের চেকপোস্ট-কাস্টমস কাউন্টারে লোক থাকে। তবে সন্ধ্যের পর গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যায় বলেই লোকজন যাতায়াত করে না।
–ও।
নীরোদবাবু একটু থেমে বললেন, বর্ডারের খুব কাছাকাছি যারা যাবেন বা কিছু ব্যবসাদার কাজকর্মে আটকে গেলে রাত্রেও যাতায়াত করেন। ওরা ছাড়া আর বিশেষ কেউ যাওয়া-আসা করেন না।
এবার আমি বলি, কী যেন বলবেন বলছিলেন?
–একটা ঘটনার কথা বলব।
-বলুন।
নীরোদবাবু সেদিন ভিতরে বসে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের কি যেন কাজ করছিলেন। একজন ইন্সপেক্টর এসে বললেন, নীরোদদা, একজন ভদ্রমহিলা আপনার জন্য আমাদের কাউন্টারের এখানে অপেক্ষা করছেন।
নীরোদবাবু একটু ব্যস্তই ছিলেন। তাই কাজ করতে করতেই জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোন আত্মীয়-স্বজন নাকি?
-তা তো জানি না।
-আচ্ছা আসছি।
হাতের কাজ সেরে উনি সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের ঘর ঘুরে কাস্টমস চেকিং কাউন্টারের সামনে গিয়ে একবার চারদিক দেখে নিলেন। না, জানাশোনা কেউ নেই। ওকে দেখেই অন্য একজন ইন্সপেক্টর বললেন, নীরোদবাবু, এই যে ইনি আপনার খোঁজ করছেন।
নীরোদবাবু কিছু বলার আগেই ঐ ভদ্রমহিলা কোলের ছোট বাচ্চাকে কোনমতে সামলে নিয়েই ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। নীরোদবাবু অবাক হয়ে বললেন, আরে! কী করছেন?
ভদ্রমহিলা নীরোদবাবুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, দাদা, আপনি আমাকে চেনেন না কিন্তু আমি আপনাকে শুধু চিনিই না সারা জীবনেও আপনাকে ভুলব না।
উনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন বলুন তো?
ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সকৃতজ্ঞ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে নিঃসঙ্কোচে বললেন, দেখছেন তো দাদা, আমার শ্বেতী। হাজার লেখাপড়া শিখলেও ঘুষ না দিলে কী আমার মত মেয়ের বিয়ে হয়?
শুধু নীরোদবাবু না, কাস্টমস কাউন্টারের সমস্ত ইন্সপেক্টর, কর্মী ও বেশ কিছু যাত্রী অবাক হয়ে ওঁর কথা শোনেন।
ভদ্রমহিলা এবার বললেন, দাদা, আপনি দয়া না করলে আমার বিয়ে হতো না, তা কী জানেন?
বিস্মিত নীরোদবাবু বললেন, আমি আবার আপনার কী উপকার করলাম?
-হ্যা দাদা, করেছেন। ভদ্রমহিলা এক নিঃশ্বাসে বলে যান, আমার ননদের দাবী মেটাবার জন্য আমার বাবা বাধ্য হয়ে অনেক বিদেশী জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন। আপনি ঐসব জিনিসপত্র ছেড়ে না দিলে সত্যি আমার বিয়ে হতো না।
নীরোদবাবু একটু হেসে বললেন, কিন্তু আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।
–গত বছর সাতুই ফেব্রুয়ারী রাত নটা-সাড়ে নটার সময় আমার বাবা অনেক বিদেশী জিনিসপত্র নিয়ে ওপার থেকে এপারে এসেছিলেন।
প্রতিদিন কত শত শত মানুষ এই সীমান্ত দিয়ে পারাপার করেন। কে কার কথা মনে রাখে? নাকি ইচ্ছা করলেও মনে রাখা যায়? অসম্ভব। তবু নীরোদবাবু একবার সেই দেড় বছর আগের রাত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেন।
ভদ্রমহিলা একটু হেসে বলেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি বাবাকে প্রথমে বিশ্বাস করেন নি কিন্তু তারপর হঠাৎ বাবা হাউহাউ করে কেঁদে উঠল…
হঠাৎ নীরোদবাবুর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বেশ একটু উত্তেজিত হয়েই বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনার বাবা তো বাগেরহাটে থাকেন, তাই না?
-হ্যাঁ।
–আপনার বাবার নাম তো মাধব সরকার, তাই না।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তারই মেয়ে জবা।
ঐ খাকি পোশাকপরা শুধু নীরোদবাবু না, কাস্টমস কাউন্টারের সবাই আনন্দে খুশিতে চোখের জল ফেলেছিলেন। তারপর জবা আর ঐ কয়েক মাসের বাচ্চা ও ছোট ভাইকে নিয়ে সে কী আনন্দোৎসব!
নীরোদবাবু আমাকে বলেছিলেন, জানেন বাচ্চুবাবু, ভদ্রবেশী চোর ও মিথ্যাবাদী মানুষ দেখতে দেখতে আমরা কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারি না। সেদিন রাত্রে বাগেরহাটের ঐ ব্যবসাদার মাধব সরকারকেও প্রথমে আমি বিশ্বাস করনি কিন্তু তার চোখের জলের কাছে আমি হেরে গেলাম।
আমি অবাক হয়ে ওঁর কথা শুনি।
উনি বলে যান, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, আমরাও মাঝে মাঝে মানুষের উপকার করি। এই জবার মত ভাইবোনের সংখ্যা আমাদের নেহাত কম নয়।
নীরোদবাবু লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, জীবনে নিশ্চয়ই অনেক পাপ করেছি কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, এইসব জবাদের কৃপাতেই শেষ পর্যন্ত বৈতরণী পার হয়ে যাব।
নিত্যর কৃপায় শুধু এপারের কাস্টমস নয়, ওপারের কাস্টমস ও চেকপোস্টও হাসতে হাসতে আমি আর জয়ন্তী পার হলাম। কপালে বোনাসও জুটে গেল। কাস্টমস সুরারিনটেনডেন্ট হবিবুর রহমান সাহেব ডাব খাওয়ালেন। ওপারের চেকপোস্টের ও-সি মহীউদ্দীন সাহেব নিজে অটোরিকশায় চড়িয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, এই দাদা-দিদিকে ঠিকমত পৌঁছে দিবি। দরকার হলে ওরা শহরের মধ্যেও তোর গাড়িতে ঘুরবেন।